কিডনি আমাদের শরীরের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ যা শরীর থেকে বর্জ্য এবং অতিরিক্ত তরল বের করতে সহায়তা করে থাকে। কিডনি নষ্ট হলে শরীরের স্বাভাবিক প্রক্রিয়াগুলি ব্যাহত হতে থাকে। প্রাথমিক পর্যায়ে কিডনি নষ্ট হওয়ার লক্ষণগুলো খুব সূক্ষ্ম হতে পারে, তবে সময়ের সাথে সাথে এই সমস্যা গুরুতর হয়ে ওঠে। কিডনি নষ্ট হওয়ার কারণ ও লক্ষণগুলি সম্পর্কে সচেতন থাকা এবং সঠিক খাদ্যাভাস মেনে চলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রাকৃতিক খাদ্যাভাস ও সঠিক জীবনধারা কিডনি সুস্থ রাখার সহায়ক হতে পারে।
কিডনি নষ্ট হওয়ার প্রাথমিক লক্ষণসমূহঃ
শরীরের দুটি কিডনির ৭০-৮০ ভাগ নষ্ট হওয়ার আগে তেমন কোনো গুরুতর লক্ষণই দেখা দেয় না। তবে প্রাথমিকভাবে নিমোক্ত লক্ষণগুলো দেখা যেতে পারে :
● অতিরিক্ত দুর্বলতা।
● ক্ষুধামন্দা বা খাওয়ার অনিচ্ছা।
● কোনো কারণ ছাড়াই বমি বমি ভাব।
● কোনো চর্মরোগ ছাড়াই শরীর চুলকানো এবং চামড়া শুষ্ক হয়ে যাওয়া।
● প্রস্রাবে প্রচণ্ড দুর্গন্ধ হওয়া।
● প্রস্রাবে বেশি বেশি ফেনা তৈরি হওয়া।
● স্বাভাবিকের চেয়ে ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া ও পরিমাণে অল্প প্রস্রাব হওয়া।
কিডনি নষ্ট হওয়ার গুরুতর লক্ষণসমূহঃ
- অতিরিক্ত ক্লান্তি ও দুর্বলতা
কিডনি রক্ত থেকে বর্জ্য ও অতিরিক্ত তরল ফিল্টার করে। যখন কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তখন শরীরে বর্জ্য পদার্থ জমা হতে শুরু করে, যা ক্লান্তি, দুর্বলতা ও মনোযোগে ঘাটতির কারণ হতে পারে।
- মূত্র পরিবর্তন
কিডনি নষ্ট হলে মূত্রের পরিমাণ ও রং পরিবর্তন হতে পারে। মূত্রের রঙ বেশি গাঢ় বা হালকা হয়ে যাওয়া, ফেনা আসা, বা মূত্রত্যাগে সমস্যা দেখা দিতে পারে। অতিরিক্ত মূত্রত্যাগ বা সম্পূর্ণ মূত্রত্যাগের ঘাটতি কিডনি সমস্যার লক্ষণ।
- পা ও হাত ফোলা
কিডনি যথাযথভাবে অতিরিক্ত তরল নিষ্কাশন করতে না পারলে শরীরে ফোলা শুরু হতে পারে। বিশেষ করে পা, পায়ের পাতা এবং হাতের আঙুলে ফোলা দেখা দিতে পারে।
- ত্বকের শুষ্কতা ও চুলকানি
কিডনি রক্তের বিভিন্ন খনিজ ও পুষ্টি উপাদানের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। যখন কিডনি ঠিকমতো কাজ করে না, তখন শরীরে খনিজের ভারসাম্য বিঘ্নিত হয়, যা ত্বকের শুষ্কতা ও চুলকানির কারণ হতে পারে।
- পিঠের নিচের অংশে ব্যথা
কিডনি নষ্ট হলে পিঠের নিচের দিকে, বিশেষত কোমরের দিকে ব্যথা হতে পারে। কিডনি পাথর বা সংক্রমণের কারণেও এই ধরনের ব্যথা দেখা যেতে পারে।
- উচ্চ রক্তচাপ
কিডনি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিডনি ঠিকমতো কাজ না করলে রক্তচাপ বেড়ে যেতে পারে, যা কিডনি নষ্ট হওয়ার অন্যতম লক্ষণ।
- বমি বমি ভাব ও ক্ষুধামন্দা
শরীরে বর্জ্য পদার্থ জমা হতে শুরু করলে বমি বমি ভাব, ক্ষুধামান্দ্য এবং কখনও কখনও বমিও হতে পারে। এটি কিডনি নষ্ট হওয়ার অন্যতম একটি প্রাথমিক লক্ষণ।
- শ্বাসকষ্ট
কিডনি সঠিকভাবে কাজ না করলে শরীরে অতিরিক্ত তরল জমা হতে শুরু করে, যা ফুসফুসে তরল জমার কারণ হতে পারে এবং এর ফলে শ্বাসকষ্ট দেখা দিতে পারে।
- মাথা ঘোরা ও মনোযোগে সমস্যা
রক্তে বিষাক্ত পদার্থ জমা হলে মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা হ্রাস পায়, ফলে মাথা ঘোরা এবং মনোযোগের ঘাটতি দেখা দিতে পারে।
কিডনি সুস্থতা বজায় রাখতে প্রাকৃতিক খাদ্যাভাসঃ
আপনি যা খাবেন তাই আপনার স্বাস্থ্যে প্রতিফলিত হবে। তাই অন্যান্য অঙ্গের মতোই কিডনির সুরক্ষায়ও বিশেষ কিছু খাবার দরকার হয়। স্বাস্থ্যবান হৃদপিণ্ডের মতোই স্বাস্থ্যবান কিডনি থাকাটাও জরুরি। কিডনিদের প্রধান কাজ হলো দেহ থেকে বর্জ্য বের করে দেওয়া এবং ক্ষতিকর টক্সিন বা বিষ অপসারণের মাধ্যমে দেহ থেকে অতিরিক্ত পানি বের করে দেওয়া। এছাড়াও কিডনি ইলেকট্রোলাইটস এবং অন্যান্য তরলের ভারসাম্য রক্ষা করে। এমনই গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গকে সুস্থ রাখতে কিডনির জন্য সঠিক ও কার্যকারী খাদ্যাভ্যাসও জরুরি।
- পর্যাপ্ত পানি পান
পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করা কিডনি সুস্থ রাখার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপায়গুলোর একটি। পানি কিডনি থেকে বর্জ্য পদার্থ অপসারণে সাহায্য করে এবং মূত্রনালীর সংক্রমণ প্রতিরোধে সহায়ক। সাধারণত একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষকে দিনে ৮-১০ গ্লাস পানি পান করার পরামর্শ দেওয়া হয়। তবে কিডনি রোগের জন্য ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী পানির পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
- ফল এবং শাকসবজি
- কিডনি সুস্থ রাখতে উচ্চমানের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ ফল ও সবজি খাওয়া উচিত। বিশেষ কিছু ফল ও শাকসবজি কিডনি রক্ষায় কার্যকর :
- বেরি (ব্লুবেরি, স্ট্রবেরি, ক্র্যানবেরি): এই ফলগুলোতে অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের পরিমাণ বেশি থাকে যা কিডনিকে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস থেকে রক্ষা করে।
- বেল পেপার (ক্যাপসিকাম): এটি ভিটামিন সি ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে ভরপুর যা কিডনির কার্যক্রমে সহায়তা করে।
- পেঁয়াজ এই খাবারই প্রদাহনাশক এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ যা কিডনির কার্যক্রমে সহায়ক হতে পারে।
- হালকা প্রোটিনঃ কিডনি রোগীদের জন্য প্রোটিনের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করা গুরুত্বপূর্ণ। অতিরিক্ত প্রোটিন গ্রহণ কিডনির উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে, তাই হালকা প্রোটিন যেমন মাছ, ডাল, ও বাদাম খাওয়া উপকারী হতে পারে।
- মাছ: মাছ ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিডের একটি ভালো উৎস, যা প্রদাহ কমাতে এবং কিডনির স্বাস্থ্যে সহায়ক।
- বাদাম ও বীজ: বাদাম, চিয়া সিড, ফ্ল্যাক্সসিডে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড থাকে যা কিডনির প্রদাহ কমাতে সহায়ক।
- কম লবণযুক্ত খাবারঃ লবণ রক্তচাপ বাড়ায়, যা কিডনির ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করে। কম লবণযুক্ত খাবার গ্রহণ করলে কিডনির ওপর চাপ কমবে এবং উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকবে। খাবারে লবণের পরিমাণ কমাতে এবং প্রাকৃতিক সুগন্ধি মশলা ব্যবহার করতে পারেন।
- পটাসিয়াম ও ফসফরাস নিয়ন্ত্রণঃ কিডনি নষ্ট হলে পটাসিয়াম ও ফসফরাস নিয়ন্ত্রণ করা গুরুত্বপূর্ণ। এই দুটি খনিজ কিডনির মাধ্যমে নিষ্কাশিত হয়। কিডনি রোগীদের জন্য পটাসিয়াম ও ফসফরাসের মাত্রা বেশি হওয়া ক্ষতিকর হতে পারে। নিম্ন পটাসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার যেমন আপেল, স্ট্রবেরি এবং কম ফসফরাস সমৃদ্ধ খাবার যেমন ফুলকপি খাওয়া উপকারী হতে পারে।
- হার্বাল চাঃ কিছু হার্বাল চা কিডনির স্বাস্থ্য রক্ষায় সাহায্য করতে পারে।
- জলপাই তেল/ অলিভওয়েলঃ জলপাই তেল একটি স্বাস্থ্যকর ফ্যাট যা প্রদাহ কমাতে সহায়ক এবং কিডনি সুস্থ রাখার জন্য উপকারী। সালাদে বা রান্নায় জলপাই তেল ব্যবহার করা যেতে পারে
- রসুনঃ রসুনে রয়েছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং অ্যান্টিইনফ্লেমেটরি গুণাবলী, যা কিডনির সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে, যা কিডনি সুস্থ রাখতে সহায়ক। রসুন রক্তের কোলেস্টেরল মাত্রাও নিয়ন্ত্রণ করে।
- শসাঃ শসা কিডনির জন্য অত্যন্ত উপকারী একটি সবজি। এতে প্রচুর পানি এবং খনিজ উপাদান থাকে, যা কিডনির কার্যক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। এটি কিডনির বিষাক্ত উপাদান দূর করতে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে।
- আপেলঃ আপেল কিডনির স্বাস্থ্য রক্ষায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ফল। এতে প্রচুর ফাইবার এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে, যা কিডনির ক্ষতি প্রতিরোধে সহায়তা করে। নিয়মিত আপেল খেলে শরীর থেকে বিষাক্ত পদার্থ দূর হয় এবং কিডনি সুস্থ থাকে।
- গাজরঃ গাজরেও প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে, যা কিডনি রোগের ঝুঁকি কমায়। এটি রক্তের বিশুদ্ধতা বজায় রাখতে এবং কিডনির কার্যকারিতা বাড়াতে সাহায্য করে। নিয়মিত গাজর খাওয়া কিডনির স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।
- বিটরুট: বিটরুট একটি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ সবজি, যা কিডনির কার্যক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। এটি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে এবং কিডনির ক্ষতি প্রতিরোধে কার্যকরী।
- পালং শাক: পালং শাকে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এবং খনিজ থাকে, যা কিডনি সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। এতে ম্যাগনেসিয়াম এবং আয়রন থাকে, যা কিডনির সঠিক কার্যকারিতা বজায় রাখতে সহায়ক।
- টক জাতীয় ফল: টক জাতীয় ফল যেমন লেবু, কমলা, জাম্বুরা কিডনির জন্য উপকারী। এ ধরনের ফলে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি থাকে, যা কিডনি থেকে বর্জ্য পদার্থ বের করতে সাহায্য করে। এগুলো কিডনিতে পাথর হওয়ার ঝুঁকিও কমায়।
- ফ্ল্যাক্স সিড (Flaxseeds): ফ্ল্যাক্স সিডে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড থাকে, যা কিডনির প্রদাহ প্রতিরোধে সাহায্য করে। নিয়মিত ফ্ল্যাক্স সিড খেলে কিডনির কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায় এবং কিডনি সুরক্ষিত থাকে।
পরিশেষে বলা যায় যে, কিডনি যেহেতু আমাদের শরীরের একটি গুরুত্বপূর্ন অংশ, তাই কিডনিকে সুস্থ্য রাখা আমাদের প্রয়োজন। সুতরাং কিডনির যত্ন নেওয়ার জন্য সঠিক খাদ্যাভাস মেনে চলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই কিছু প্রাকৃতিক খাবার কিডনি সুস্থ রাখতে এবং কিডনি সমস্যা প্রতিরোধে সহায়ক হতে পারে।