বর্তমান সময়ে অতিরিক্ত ওজন একটি বড় সমস্যা। অতিরিক্ত ওজন কমাতে কত মানুষ কত কিই না করেন! তবে এমনও অনেক মানুষ আছেন যারা এই ওজন বাড়ানোর জন্যই আপ্রাণ চেষ্টা করে থাকেন। স্বাভাবিক এর চেয়ে ওজন কম হওয়ায় অনেকেই চিন্তিত থাকেন সবসময়। শরীরের বি.এম.আই ১৫ এর নিচে হলে ক্ষীণকায় দেহ এবং ১৫ থেকে ১৮.৫ এর মধ্যে হলে কম ওজনের দেহ বলা হয়। অর্থাৎ যারা ওজন বাড়াতে চান, তারা একটা ভারসাম্য পূর্ণ ওজন চান। কম ও না, আবার বেশি ও না। কিন্তু এই কাজটি অনেক কঠিন। অনেকে বিভিন্ন রকমের ট্যাবলেট, ইনজেকশন নিয়ে সাময়িক ওজন বাড়ায় তবে স্বল্পমেয়াদী এবং কম সময়ে এসব প্রক্রিয়ার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে। যারা অনেক খোজাখুজি করেও সঠিক নির্দেশনা জানতে পারেন নি তাদের জন্যেই আজকেই এর ব্লগ।
আজকের এই ব্লগে আমরা জানবো দীর্ঘস্থায়ীভাবে স্বাস্থ্যকর উপায়ে ওজন বাড়ানোর উপায় সমূহ।
Table of Contents
Toggleস্বাস্থ্যকর উপায়ে ওজন বাড়ানোর উপায় সমূহ – ঘরে বসেই ওজন বাড়ানোর উপায়ঃ
স্বাভাবিক এর চেয়ে কম ওজন হওয়ার জন্য বেশকিছু কারণ রয়েছে । কেন ওজন কম এর যথাযথ কারণ সবার আগে জানা জরুরী। অনেকে মনে করেন বংশগতভাবে ওজন কম হওয়ায় এটাই চিরস্থায়ী কারণ। স্বাভাবিক ওজন হওয়াটা হয়তো সম্ভব না। এই ধারণা থেকে এখন বের হয়ে আসার সময় হয়েছে। পুষ্টিবিদ ও চিকিৎসক এর সাথে কথা বলে মূল সমস্যা চিহ্নিত করাটা সবার আগে প্রয়োজন। তারপর সে অনুযায়ী খাদ্যভ্যাস ও অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করলে অবশ্যই দীর্ঘমেয়াদী ভাবে ভারসাম্য পূর্ণ ওজন বাড়ানো সম্ভব।
১) উচ্চ ক্যালোরি সমৃদ্ধ পুষ্টিকর খাবার ( Increase Caloric Intake With Nutrient – Dense Foods)
ওজন বাড়ানোর জন্য আপনার শরীর থেকে যে পরিমাণ ক্যালোরি বার্ন হয় তার চেয়ে বেশি ক্যালোরি গ্রহণ করতে হবে। পুষ্টিকর-ঘন, বাদাম, বীজ, আভাকাডো এবং পুরো শস্যের মতো সম্পূর্ণ খাবারের উপর ফোকাস করুন, যা “খালি” বা প্রক্রিয়াজাত না করেই স্বাস্থ্যকর ক্যালোরি সরবরাহ করে। প্রতিদিন ৩০০-৫০০ ক্যালোরির উদ্বৃত্ত আপনার শরীরে ওজন বৃদ্ধির লক্ষ্যে জমা হয় এবং যা চর্বি বৃদ্ধির পরিবর্তে আপনার পেশি বা মাসেল বাড়ায়।
২) প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার ( Eat More Protein)
পেশী ভর তৈরির জন্য প্রোটিন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যা স্বাস্থ্যকর ওজন বৃদ্ধির একটি অপরিহার্য উপাদান। চর্বিহীন মাংস, দুগ্ধজাত খাবার, ডিম, লেবু এবং বাদামের মতো উচ্চ প্রোটিনযুক্ত খাবারের জন্য লক্ষ্য রাখুন। প্রোটিন বিল্ডিং ব্লক (অ্যামিনো অ্যাসিড) সরবরাহ করে যা পেশী টিস্যু মেরামত এবং তৈরি করতে সাহায্য করে, বিশেষ করে যখন শক্তি বৃদ্ধির জন্য ব্যায়াম করা হয়।
৩) প্রতিরোধ প্রশিক্ষণ এবং ব্যায়াম (Incorporate Resistance Training)
শক্তি বা প্রতিরোধের প্রশিক্ষণ অতিরিক্ত ক্যালোরিকে চর্বির পরিবর্তে পেশীতে রূপান্তর করতে সহায়তা করে। ওয়েট লিফটিং, রেজিস্ট্যান্স ব্যান্ড ওয়ার্কআউট এবং বডিওয়েট ব্যায়ামের মতো ব্যায়াম নিয়মিত করা উচিত। পেশী হাইপারট্রফি (বৃদ্ধি) ঘটে যখন পেশী তন্তুগুলি প্রতিরোধের শিকার হয়, যখন যথাযথ প্রোটিন গ্রহণের সাথে এই ব্যায়াম একসাথে মিলিত হয়।
৪) স্বাস্থ্যকর চর্বি বাড়ান (Increase Healthy Fats)
স্বাস্থ্যকর চর্বিগুলি ক্যালোরি-ঘন এবং স্বাস্থ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব ছাড়াই ওজন বৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্যভাবে অবদান রাখে। আপনার খাদ্যতালিকায় অলিভ অয়েল, অ্যাভোকাডো, বাদাম, বীজ এবং চর্বিযুক্ত মাছ (যেমন, স্যামন) এর মতো চর্বি অন্তর্ভুক্ত করুন। স্বাস্থ্যকর অসম্পৃক্ত চর্বি, যেমন ওমেগা -3 এস, অনেক স্বাস্থ্য সুবিধার সাথে যুক্ত এবং ক্যালরির পরিমাণ বাড়াতে সাহায্য করে।
৫) ঘন ঘন খান -স্ন্যাকস ( Eat Frequently- Multiple Meals & Snacks)
কার্যকরভাবে ওজন বাড়াতে, আপনার প্রধান খাবারের মধ্যে স্ন্যাকস সহ প্রতি 3-4 ঘন্টা পরপর খাওয়ার চেষ্টা করুন। এই কৌশলটি আপনাকে যে কোনো সময়ে অতিরিক্ত পেট ভরা অনুভূতি থেকে বাধা দেবে তবে একটি কনস্ট্যান্ট ক্যালোরি গ্রহণ নিশ্চিত করে। শরীরে সারা দিন খাবার ছড়িয়ে দেওয়া শক্তির মাত্রা স্থিতিশীল রাখতে সাহায্য করে, হজমে সহায়তা করে এবং একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ ক্যালরি উদ্বৃত্ত হিসাবে শরীরে জমা করতে থাকে।
৬) জটিল কার্বোহাইড্রেট গ্রহণ (Focus on Complex Carbs)
জটিল কার্বোহাইড্রেট দীর্ঘস্থায়ী শক্তি সরবরাহ করে এবং পেশী পুনরুদ্ধারে সহায়তা করে। ভালো উৎসের মধ্যে রয়েছে মিষ্টি আলু, গোটা শস্য, লেগুম এবং কুইনো। জটিল কার্বোহাইড্রেট টেকসই শক্তি সরবরাহ করে এবং পেশীগুলিতে গ্লাইকোজেন স্টোরগুলিকে পুনরায় পূরণ করতে সহায়তা করে, যা পুনরুদ্ধার এবং বৃদ্ধির জন্য অনেক বেশি প্রয়োজনীয়।
৭) হাইড্রেটেড থাকা তবে খাবারের আগে পানি পান করা এড়িয়ে চলুন ( Stay Hydrated but Avoid Drinking Water before Meals)
পানি হজম এবং সামগ্রিক স্বাস্থ্যের জন্য অপরিহার্য। খাবারের ঠিক আগে প্রচুর পরিমাণে জল খাওয়া এড়িয়ে চলুন, কারণ এটি ক্ষুধা কমাতে পারে এবং ক্যালোরি গ্রহণে হস্তক্ষেপ করতে পারে। খাবারের আগে পানি পান করা পেট ভরার অনুভূতি তৈরি করতে পারে এবং আপনার পর্যাপ্ত খাওয়ার ক্ষমতা হ্রাস করতে পারে, যা ওজন বৃদ্ধির জন্য বিপরীতমুখী অর্থাৎ স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ওজন বৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্থ করে।
উপরে উল্লেখিত উপায়ে দীর্ঘস্থায়ী ভাবে ওজন বৃদ্ধি সম্ভব। তবে এই উপায়গুলি অনুসরণ করে আমাদের উচিৎ খাদ্য নির্বাচন করা। সকাল, দুপুর, সন্ধ্যা কিংবা রাত, এই সময়গুলিতে যে ধরনের খাবার নির্বাচন করা যেতে পারে তা হলো:
সকালের নাস্তা
সকালের নাস্তায় ডিম, দুধ এবং কলা রাখা একটি ভালো অভ্যাস। ডিম ও দুধে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান থাকে, যা শরীরের জন্য খুবই উপকারী। এগুলো সহজেই অন্যান্য খাবারের সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়া যায়। তবে শুধুমাত্র ডিম, দুধ এবং কলা খেলেই হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। এর সাথে রুটি, নুডুলস বা অন্য কোনো স্বাস্থ্যকর খাবারও যোগ করতে পারেন। তবে, খাবারে বেশি চর্বি বা তেল এড়িয়ে চলাই ভালো।
অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, এত ধরনের ফল থাকা সত্ত্বেও নাস্তায় কেন কলা? কলা সহজলভ্য একটি ফল, যা বিভিন্ন পুষ্টিগুণে পরিপূর্ণ। বছরের প্রায় সব সময়ই এটি পাওয়া যায় এবং এটি খাওয়াও সহজ। তবে আপনি চাইলে মৌসুমি বা অন্য কোনো ফলও বেছে নিতে পারেন, কিন্তু নাস্তায় কলা অবশ্যই রাখার চেষ্টা করুন।
দুপুরের খাবার
দুপুরের খাবার সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ। তবে অনেক বেশি কিছু আয়োজন করার কিছু নেই। ভাতের সাথে মসুর ডাল খুব ভালো সংযোজন। মুরগির মাংস রাখা যেতে পারে। তবু গরু কিংবা খাশির মাংশ রাখলেও তা মাঝে মাঝে রাখা উচিৎ। নিয়মিত রাখলে সেটা বরং ক্ষতিকর। তাই ক্ষতি ছাড়াই ডাল এবং মুরগির মাংস পর্যাপ্ত পুষ্টির যোগান দিবে। শাকসবজি এবং মাছ, বিশেষ করে সামুদ্রিক মাছও রাখা যেতে পারে। সহজ কথায় দুপুরের খাবারে আপনি যাই রাখেন বা কেন চেষ্টা করবেন মসুরের ডাল রাখার জন্য।
বিকেলের নাস্তা
উচ্চ ক্যালোরিযুক্ত বিভিন্ন ধরনের বাদাম যেমন পেস্তাবাদাম, কাজুবাদাম, চিনাবাদাম, কাঠবাদাম, আখরোট ইত্যাদি রাখতে পারেন। এছাড়াও খেজুর এবং টকদই রাখুন। নিয়মিত মিষ্টি দই সবসময় পরিহার করবেন। টক দইয়ের সাথে কিশমিশ মিশ্রিত করে খেতে পারেন। অবশ্যই ফাস্টফুড এড়িয়ে চলবেন, ডায়াবেটিস যাদের আছে তারা চিনিযুক্ত খাবার সম্পূর্ণভাবে পরিহার করবেন।
রাতের খাবার
দুপুরের এবং রাতের খাবার একইরকম, শুধু মনে রাখতে হবে ডাল যেন থাকে। অনেকেই খবার শেষে ডেজার্ট খেতে পছন্দ করেন, তারা সরাসরি চিনিযুক্ত কিছু খাবেন না। মিষ্টি ফল খেতে পারেন। খেজুর, কিশমিশ ভালো সংযোজন এক্ষেত্রে।
এর বাইরে বিভিন্ন সবজি বীজ যেমন শিমের বীজ, ছোলা, কুমড়া বীজ, ফেলন বীজ, কালোজিরা, বিনস ইত্যাদি তে রয়েছে প্রচুর পুষ্টিগুণ।
স্বাস্থ্যকর উপায়ে ওজন বাড়ানোর জন্য একটি ভারসাম্যপূর্ণ পদ্ধতির প্রয়োজন যাতে পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার, সামঞ্জস্যপূর্ণ শক্তি প্রশিক্ষণ এবং জীবনধারা পরিবর্তনের জন্য সমন্বয় করে। পুষ্টিকর খাবারের সাথে আপনার ক্যালোরি গ্রহণের পরিমাণ বাড়িয়ে, পেশী তৈরির ব্যায়ামগুলিতে ফোকাস করুন এবং আপনার সামগ্রিক জীবনধারার অভ্যাসের প্রতি মনোযোগী থাকার মাধ্যমে আপনি ধীরে ধীরে এবং টেকসই ওজন বৃদ্ধি পেতে পারেন। আপনার পরিকল্পনাটি আপনার নির্দিষ্ট প্রয়োজন অনুসারে তৈরি করার জন্য সর্বদা একজন স্বাস্থ্যসেবা পেশাদার কিংবা পুষ্টিবিদের সাথে পরামর্শ করুন।