পৃথিবীতে ফুসফুস ক্যান্সার এর পরে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যায় প্রোস্টেট সমস্যায়। ষাটোর্ধ তিন চতুর্থাংশ পুরুষদের মাঝে এই সমস্যা দেখা যায়। প্রোস্টেট স্বাস্থ্য তাই বর্তমান সময়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত তিন ধরনের প্রোস্টেট সমস্যা হতে দেখা যায়।
- প্রোস্টেটাইটিস (Prostatitis) – প্রোস্টেট গ্রন্থির প্রদাহজনিত সমস্যা।
- বিনাইন প্রোস্টেটিক হাইপারপ্লাসিয়া (Benign Prostatic Hyperplasia – BPH) – প্রোস্টেট গ্রন্থির অস্বাভাবিক বৃদ্ধিজনিত সমস্যা।
- প্রোস্টেট ক্যান্সার (Prostate Cancer) – প্রোস্টেট গ্রন্থির কোষে অস্বাভাবিক ও নিয়ন্ত্রণহীন কোষবৃদ্ধিজনিত সমস্যা।
এই তিনটি সমস্যা একটি আরেকটিকে প্রভাবিত না করলেও একই লোকের একইসাথে একাধিক সমস্যা থাকতে পারে। প্রোস্টেট স্বাস্থ্য আমাদের জীবনযাত্রা দ্বারা প্রভাবিত। কাজেই প্রোস্টেট স্বাস্থ্য বজায় রাখতে আমাদের করণীয়গুলো জানা উচিৎ। সেইসাথে প্রোস্টেট সমস্যা শনাক্ত করার উপায় ও জানতে হবে। আজকের এই ব্লগে আমরা সবটা জানবো।
প্রোস্টেট কি?
প্রোস্টেট হলো পুরুষ প্রজনন তন্ত্রের একটি ছোট গ্রন্থি যা মুত্রাশয়ের নিচে এবং মুত্রনালীর চারপাশে অবস্থিত। প্রোস্টেট গ্রন্থির প্রধান কাজ হলো সিমেন বা বীর্যের তরল উৎপাদন করা, যা শুক্রাণু কে ঠিকঠাক মতো চলাচলে সহায়তা করে। বীর্য বা সিমেন এর ৩০ শতাংশই প্রোস্টেটিক ফ্লুইড। প্রোস্টেট আকারে দেখতে অনেকটা সুপারির মতো। এটি বয়স বাড়ার সাথে সাথে বড় হয়।
পুরুষের প্রোস্টেট স্বাস্থ্য বজায় রাখার উপায়
প্রোস্টেট স্বাস্থ্য বজায় রাখার সর্বোত্তম পন্থা হলো একটি নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপন। এই নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপনের মধ্যে যে বিষয়গুলো সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পায় তা নিচে দেওয়া হলো।
স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস
প্রোস্টেট স্বাস্থ্য বজায় রাখতে পুষ্টিকর খাদ্যাভ্যাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সবুজ শাকসবজি, টমেটো, গাজর এবং বাদামজাতীয় খাবার এইক্ষেত্রে পথপ্রদর্শক। টমেটোতে থাকা লাইকোপিন প্রোস্টেট ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। এছাড়াও ওমেগা-৩, ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ মাছ। যেমন- স্যামন এবং টুনা প্রোস্টেটের প্রদাহ কমাতে কার্যকরি।
শারীরিক পরিশ্রম
শারীরিক পরিশ্রম শরীরের রক্ত সঞ্চালন বাড়ায়। ফলে প্রোস্টেট এর কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং প্রদাহ কমাতে সহায়ক ভূমিকা রাখে। তাই দিনে অন্তত আধা ঘণ্টা ব্যায়াম প্রয়োজন।
ওজন নিয়ন্ত্রণ
অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা প্রোস্টেট ক্যান্সার এর ঝুঁকি বাড়ায়।
পর্যাপ্ত পানি পান
প্রোস্টেট এর কার্যক্রম স্মুথ রাখতে পানি পান নিশ্চিত করতে হবে। শরীরের বিষাক্ত পদার্থ বের করে মূত্রাশয় পরিষ্কার রাখতে পর্যাপ্ত পানি খেতে হবে।
ধুমপান ও মদ্যপান পরিহার
ধুমপান প্রোস্টেট ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায় এবং মদ্যপান প্রোস্টেট এর জ্বালাপোড়া সৃষ্টি করে। কাজেই প্রোস্টেট এর স্বাস্থ্য বজায় রাখতে এসব পরিহার করা বাঞ্ছনীয়।
ভিটামিন-ডি গ্রহণ
প্রোস্টেট এর কোষের কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে সহায়ক ভিটামিন – ডি। সকালে সূর্যের আলো থেকে প্রাকৃতিক ভাবে ভিটামিন – ডি পাওয়া যায়। প্রয়োজনে সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করা যেতে পারে।
উচ্চ চর্বিযুক্ত খাদ্য পরিহার
উচ্চ চর্বিযুক্ত খাবার বিশেষ করে স্যাচুরেটেড এবং ট্রান্স ফ্যাট প্রোস্টেট সমস্যার ঝুঁকি বাড়ায়। যা কোলেস্টেরল এর মাত্রা বাড়িয়ে প্রদাহ সৃষ্টি করে। তাই এসব খাবার পরিহার করা উচিৎ।
কুমড়া বীজের নির্যাস সেবন
কুমড়ো বীজের নির্যাসে রয়েছে জিঙ্ক। যা প্রোস্টেট এর প্রদাহ কমাতে কার্যকরী। এছাড়াও কুমড়া বীজের নির্যাসে রয়েছে প্রোস্টেট স্বাস্থ্যের সম্পূরক উপাদান।
নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা
বয়স ৫০ পার হলে প্রতিবছর একবার প্রোস্টেট পরীক্ষা করানো উচিৎ। নিয়মিত প্রোস্টেট পরীক্ষা করালে প্রোস্টেট ক্যান্সার এবং অন্যান্য সমস্যা প্রাথমিক অবস্থায় শনাক্ত করা সম্ভব।
প্রোস্টেট সমস্যা শনাক্ত করার উপায়
প্রোস্টেট এর প্রদাহ, বৃদ্ধি কিংবা ক্যান্সার সমস্যা প্রাথমিক অবস্থাতেই কিছু বিশেষ লক্ষণ প্রকাশিত হয়। যেমন:
প্রস্রাবের সমস্যা
প্রোস্টেট এর সমস্যা হলে প্রস্রাবে বাঁধার সৃষ্টি হতে পারে। যেমন প্রস্রাবে অনেক সময় লাগা, ঘন ঘন প্রস্রাব বিশেষ করে রাতের বেলায় বারবার প্রস্রাবের প্রয়োজন অনূভুত হওয়া।
মূত্রাশয়ে চাপ অনুভব
মূত্রাশয়ে সর্বদা চাপ অনূভুত হয় এবং প্রস্রাব শেষ করলেও চাপ কমে না। এ ধরনের সমস্যা প্রোস্টেট সমস্যারই লক্ষণ।।
প্রস্রাবে রক্ত যাওয়া
প্রোস্টেট সমস্যা থাকলে মাঝে মাঝে প্রস্রাবের সাথে রক্ত যেতে পারে।
শুক্রাণুর পরিবর্তন
শুক্রাণুর পরিমাণ কমে যাওয়া কিংবা বীর্যের সাথে রক্তের উপস্থিতি প্রোস্টেট সমস্যার লক্ষণ।
হাড়ে ব্যথা
বিশেষ করে মেরুদণ্ড ও কোমরের হাড়ে ব্যথা অনুভূত হলে তা প্রোস্টেট ক্যান্সার এর লক্ষণ হতে পারে।
বেদনাদায়ক বীর্যপাত
বীর্যপাত হওয়ার সময় জ্বালাপোড়া বা ব্যথা অনুভূত হওয়া প্রোস্টেট ক্যান্সার এর লক্ষণ।
বয়স ৬০ অতিক্রম করলেই প্রোস্টেট সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা ৭৫% বেড়ে যায়। তবে শুধুমাত্র বয়স্করাই এই সমস্যায় ভুগে থাকেন ভাবাটা বোকামি। অনিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপন করলে যে কেউ ই প্রোস্টেট সমস্যায় আক্রান্ত হতে পারে। তাই প্রোস্টেট সমস্যা নিয়ে সম্যক ধারণা থাকা সবার জন্য জরুরি। যেন কেউ প্রোস্টেট সমস্যায় পড়লে প্রাথমিক অবস্থাতেই চিকিৎসা করাতে পারে। তবে এই ব্যাপারে উদাসীনতা দীর্ঘস্থায়ী জটিলতা সহ কিডনি বিকল পর্যন্ত করে দিতে পারে। কাজেই প্রোস্টেট সমস্যা নিয়ে আমাদের সচেতন থাকা উচিৎ।