বিশ্বজুড়ে থাইরয়েড সমস্যায় ভুগছেন বহু মানুষ। সারা পৃথিবী জুড়ে যার পরিমাণ প্রায় ১২ শতাংশ। গলার সামনের দিকে দু’পাশে অবস্থিত গুরুত্বপূর্ণ অন্তঃস্রাবী গ্রন্থির নাম থাইরয়েড। এটি দুই ধরনের হরমোন নিঃসরণ করে। ট্রাইয়াইডোথাইরোনিন বা T3 এবং থাইরক্সিন বা T4। শরীরের বিভিন্ন ক্রিয়াকলাপ এই হরমোন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। নির্দিষ্ট মাত্রা থেকে কম বা বেশি হরমোন উৎপাদন হলেই শরীরে নানা অসামঞ্জস্যতা দেখা যায়। থাইরয়েড হরমোন কমে যাওয়া কে হাইপোথাইরয়েডিজম বলে এবং বেড়ে যাওয়া কে হাইপারথাইরয়েডিজম বলে।
আজকের এই ব্লগে থাইরয়েড হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট হলে কি কি সমস্যা হতে পারে, তার উপর বিশদভাবে আলোচনা করা হবে।
থাইরয়েড হরমোনের ভূমিকা
থাইরয়েড হরমোন মস্তিষ্কের যথাযথ বিকাশ, শরীরের শক্তি উৎপাদন, হৃদপিণ্ডের কার্যক্ষমতা এবং হাড় ও মাংসপেশির সুস্থতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। হরমোনের মাত্রা স্বাভাবিক না থাকলে এই সব শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টি হতে পারে এবং দেখা দিতে পারে বিভিন্ন ধরনের শারীরিক জটিলতা।
প্রাপ্তবয়স্কদের থাইরয়েড হরমোনের স্বাভাবিক মাত্রা
মহিলা: ১৮-২৯ বছর বয়সীদের জন্য ০.৪-২.৩৪ এমইউ প্রতি লিটার। ৩০-৪৯ বছর বয়সীদের জন্য ০.৪-৪.০ এমইউ প্রতি লিটার। এবং ৫০-৭৯ বছর বয়সী মহিলাদের জন্য স্বাভাবিক মাত্রা হলো ০.৪-৪.৬৮ এমইউ প্রতি লিটার।
পুরুষ: ১৮-৫০ বছর বয়সীদের জন্য ০.৫-৪.১ এমইউ প্রতি লিটার। ৫১-৭০ বছর বয়সীদের জন্য ০.৫-৪.৫ এমইউ প্রতি লিটার। ৭১-৯০ বছর বয়সী পুরুষদের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক মাত্রা ০.৪-৫.২ এমইউ প্রতি লিটার।
ছোটদের থাইরয়েড হরমোনের স্বাভাবিক মাত্রা
ছোটরা এমনকি ভূমিষ্ট হওয়া শিশুদের ও হরমোনজনিত সমস্যা দেখা দিতে পারে। ০-৪ দিন বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক মাত্রা ১.৬-২৪.৩ এমইউ প্রতি লিটার। ২-২০ সপ্তাহ বয়সের শিশুদের ক্ষেত্রে ০.৫৮-৫.৫৭ এমইউ প্রতি লিটার। ২০ সপ্তাহ থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত বাচ্চাদের জন্য থাইরয়েড হরমোনের স্বাভাবিক মাত্রা হলো ০.৫৫-৫.৩১ এমইউ প্রতি লিটার।
থাইরয়েড হলে যেসব সমস্যা দেখা দেয়
১) বিপাক ক্রিয়ায় সমস্যা
- হাইপোথাইরয়েডিজমে: বিপাক ক্রিয়া ধীরগতির হয়ে যায়, ফলে শরীরের শক্তি কমে শরীর দূর্বল হয়ে পড়ে।
- হাইপারথাইরয়েডিজমে: বিপাক ক্রিয়া বেড়ে যায়, শরীর দ্রুত ক্লান্ত হয়ে যায় এবং ওজন হ্রাস পায়।
২) চুল ও ত্বকের সমস্যা
- হাইপোথাইরয়েডিজমে: চুল শুষ্ক হয়ে যায়, চুল পড়ার সমস্যা বেড়ে যায় এবং ত্বক রুক্ষ হয়ে যায়।
- হাইপারথাইরয়েডিজমে: চুল পাতলা হয়ে যেতে পারে এবং ত্বক খুব বেশি ঘর্মাক্ত হয়ে যায়।
৩) হৃদস্পন্দন পরিবর্তন
- হাইপোথাইরয়েডিজমে: হৃদস্পন্দন ধীরগতির হয়ে যায়, ফলে শরীর দূর্বল লাগে।
- হাইপারথাইরয়েডিজমে: হৃৎস্পন্দন এর গতি বেড়ে যায় এবং বুক ধরফর করে।
৪) মেজাজের পরিবর্তন
- হাইপোথাইরয়েডিজমে: বিষন্ন ও মনমরা লাগে।
- হাইপারথাইরয়েডিজমে: অতিরিক্ত উদ্বেগ, অস্থিরতা এবং মেজাজ দ্রুত পরিবর্তন হয়।
৫) হাড়ের সমস্যা
- হাইপারথাইরয়েডিজমে: দীর্ঘদিন ধরে হরমোন বেশি থাকলে হাড়ের ক্ষয় হতে পারে, যা অস্টিওপরোসিস রোগের ঝুঁকি বাড়ায়।
৬) মাসিক চক্রে পরিবর্তন
- হাইপোথাইরয়েডিজমে: মাসিকের সময়কাল বেড়ে যায় এবং অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়।
- হাইপারথাইরয়েডিজমে: মাসিক চক্র অনিয়মিত কিংবা কম সময় ধরে হতে পারে
৭) হজমে সমস্যা
- হাইপোথাইরয়েডিজমে: কোষ্ঠকাঠিন্যর সমস্যা দেখা দেয়।
- হাইপারথাইরয়েডিজমে: ডায়রিয়ার মতো সমস্যা হতে পারে।
৮) ঘুমের সমস্যা
- হাইপোথাইরয়েডিজমে: অতিরিক্ত ঘুমের প্রয়োজন হতে পারে।
- হাইপারথাইরয়েডিজমে: নিদ্রাহীনতা হতে পারে, যা শারীরিক ভাবে দূর্বল করে দেয়।
৯) পেশি ও জয়েন্ট এ ব্যথা
থাইরয়েড সমস্যা থাকলে পেশি ও জয়েন্টে ব্যথা হতে পারে, বিশেষ করে হাইপোথাইরয়েডিজমে।
১০) ঠাণ্ডা বা গরম সহ্য করার ক্ষমতা কমে যাওয়া
- হাইপোথাইরয়েডিজমে: শরীরে বেশি ঠান্ডা অনুভূত হয় এবং শরীর ঠান্ডা প্রতিরোধে অক্ষম হয়ে পড়ে।
- হাইপারথাইরয়েডিজমে: গরম বেশি অনুভূত হয় ফলে অল্পতেই শরীর ঘেমে যায়।
১১) স্মৃতিশক্তি এবং মনোযোগে ঘাটতি
হাইপোথাইরয়েডিজমে মস্তিষ্কের কার্যকারিতা কমে যায় এবং মনোযোগে সমস্যা দেখা দিতে পারে। যা “মেন্টাল ফগ” নামে পরিচিত।
শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে থাইরয়েড সমস্যার প্রভাব পড়ে। এটার প্রভাবে একইসাথে একাধিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। আয়োডিনের অভাবে মূলত থাইরয়েড এর ভারসাম্য নষ্ট হয়। অতিরিক্ত থাইরয়েড হরমোন নিঃসরণ এর ফলে গঠনগত ভাবে গ্রন্থির আকার বৃদ্ধি পায়। যা টিউমার ও ক্যান্সার এর ঝুঁকি বাড়াতে পারে। তাই লক্ষণ বুঝে চিকিৎসা গ্রহণ করা উচিৎ যাতে স্বাস্থ্য সমস্যাগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।