ইসবগুলের ভুসির যত উপকারিতা ও খাওয়ার নিয়ম

খাদ্য গ্রহণের পূর্বে প্রতিটি খাদ্যের পুষ্টি ও গুণাগুণ সম্পর্কে ধারণা থাকলে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে খাদ্য নির্বাচন অনেক সহজ হয়ে যায়। ইসবগুলের ভুসির সাথে আমরা সবাই কমবেশি পরিচিত থাকলেও ইসবগুলের ভুসির পুষ্টি গুণাগুণ এবং বহুবিধ উপকারিতা সম্পর্কে আমরা অজ্ঞাত। শুধুমাত্র পেট পরিষ্কার করা ছাড়াও ইসুবগুলের ভুসির রয়েছে বহুমাত্রিক উপকারিতা। আমরা অনেকেই জানিনা ইসুবগুলের ভুসি খাওয়ার সঠিক নিয়ম কি!

আজকের এই ব্লগে আমরা ইসবগুলের ভুসি এবং এর পুষ্টি গুণাগুণ সম্পর্কে জানবো পাশাপাশি ইসবগুলের ভুসির যত উপকারিতা ও খাওয়ার নিয়ম সম্পর্কে জানবো।

 

 

ইসবগুল কি?

ইসবগুল একধরনের Psyllium Husk যা Plantago Ovata নামক গাছ থেকে পাওয়া যায়। গুল্ম জাতীয় এক ধরনের উদ্ভিদ ইসবগুল। লম্বায় দের-দুই ফুটের মতো। সুক্ষ্ম পাপড়ি বিশিষ্ট এবং ফুলগুলো আকারে খুবই ছোট হয়। ফলগুলো দুই কোষ বিশিষ্ট ৭-৮ মিলিমিটার লম্বা এবং ফলের অভ্যন্তরে ৩ মিলিমিটার লম্বা একটি নৌকাকৃতি বীজ থাকে যার খোসা খুবই পিচ্ছিল হয়। বীজ রোপণ থেকে শুরু করে ৬ মাসের মতো লাগে ফসল পেতে। মোটামুটি কার্তিক মাসের দিকে বীজ বপন করা হয় এবং চৈত্র মাসে ফসল সংগ্রহ করা হয়। এটি এক ধরনের রবিশস্য। আমাদের দেহের সবধরনের টক্সিন বের করে দিয়ে ডাইজেস্টিক ট্রাক পরিষ্কার রাখাই মূলত ইসবগুলের ভুসির কাজ।

ইসবগুলের ভুসির যত উপকারিতা ও খাওয়ার নিয়ম
ইসবগুলের ভুসির যত উপকারিতা ও খাওয়ার নিয়ম

 

ইসবগুলের পুষ্টিগুণ

ইসবগুল বহুমাত্রিক পুষ্টি উপাদান সমৃদ্ধ। মানবদেহের জন্য যার রয়েছে বিভিন্ন উপকারী দিক। এক টেবিল চামচ ইসবগুলের ভুসিতে প্রায় অর্ধেক এর বেশি পরিমানে ক্যালোরি থাকে, যা পুষ্টির প্রধান উপাদান। এছাড়াও রয়েছে ৩০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম, ১৫ মিলিগ্রাম সোডিয়াম, ১৫ মিলিগ্রাম শর্করা এবং ০.৯ মিলিগ্রাম আয়রন।

 

ইসবগুলের যত উপকারিতা

  • কোষ্ঠকাঠিন্য নিরসন

এক কথায় বলা যায় কোষ্ঠকাঠিন্যের মহৌষধ হচ্ছে ইসবগুলের ভুসি। পাইলস নামক রোগের সৃষ্টি হয় মূলত কোষ্ঠকাঠিন্য থেকেই। পাইলস রোগীদের ডাক্তাররা বরাবরই ইসবগুলের ভুসি খেতে বলেন। সকালে খালি পেটে এবং রাতে ঘুমানোর পূর্বে হালকা কুসুম গরম পানিতে ২-৩ চা চামচ ইসবগুলের ভুসি আধাঘন্টা ভিজিয়ে খেলে কোষ্ঠকাঠিন্য রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।

  • উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে :

ইসবগুলের ভুসিতে জিলাটিন নামক এক ধরনের উপাদানের উপস্থিতি মানবদেহে গ্লুকোজ এর শোষণ এবং ভাক্সগার প্রক্রিয়াকে বাঁধা প্রদান করে।  ফলে আমাদের রক্তে খুব সহজে সুগার এর পরিমাণ বাড়তে পারে না। এবং রক্তে সুগারের পরিমান নিয়ন্ত্রণ করা গেলেই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। এছাড়াও উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে ইসবগুলের ভুসি দারুণ কার্যকর।

  • গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা নিরাময়

ঘরোয়া উপায়ে গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা দূর করার সবচেয়ে কার্যকরি মাধ্যম হলো ইসবগুলের ভুসি সেবন। অ্যাসিডিটি বার্ন থেকে পাকস্থলীকে রক্ষা করতে এটি পাকস্থলীর দেয়ালে এক ধরনের প্রতিরক্ষামূলক আবরণ তৈরী করতে সহায়তা করে।  এবং হজম শক্তি ঠিক রাখার জন্য প্রয়োজনীয় এসিড নিঃসরনে ভূমিকা রাখে। ফলে গ্যাস্ট্রিক থেকে শুধু মুক্তি নয় বরং গ্যাস্ট্রিক প্রতিরোধে দারুণ উপকারী ওষুধ হিসাবে কাজ করে ইসবগুলের ভুসি।

  • ডায়রিয়া ও আমাশয় প্রতিরোধ :

বিশেষজ্ঞদের মতে ইসবগুল আমাশয় এর জীবাণু নষ্ট করতে না পারলেও পেট থেকে জীবাণু বের করতে কার্যকরি ভূমিকা রাখে।  ফলে আমাশয় থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়। এছাড়াও ডায়রিয়া প্রতিরোধে টক দই মিশ্রিত ইসবগুলের ভুসি ভালো ফল দেয়। এর পাশাপাশি পানিশূন্যতা পূরণে সহায়তা করে।

  • হজমশক্তি বৃদ্ধি

আমরা প্রায়শই হজম জনিত জটিলতায় ভুগি। এক্ষেত্রে ইসবগুলের ভুসি হজম প্রক্রিয়ার অস্বাভাবিকতা দূর করে। পাকস্থলীর গাত্র থেকে হজমে সহায়ক এনজাইম সংশ্লেষণ ত্বরান্বিত করে ইসবগুলের ভুসি। ফলে আমাদের হজমশক্তি বৃদ্ধি পায়।

  • কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ

কোলেস্টেরল হৃদরোগের কারণ।  ইসবগুলের ভুসি একটি হাইপোকোলেস্টেরলিক খাদ্য যা শরীরে ভালো কোলেস্টেরল এর পরিমাণ বৃদ্ধি এবং খারাপ কোলেস্টেরল এর পরিমাণ কমিয়ে শরীরে কোলেস্টেরল এর মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। এছাড়াও রক্তে ট্রাই-গ্লিসারাইড এর পরিমাণ কমায়, যা হৃদরোগের ঝুঁকি থেকে আমাদের মুক্ত করে।

  • দুর্বলতা দূর করতে 

আমরা মাঝেমধ্যেই শারীরিক দুর্বলতা অনুভব করি। যেকোনো কারণে এই দুর্বলতা অনুভূত হতে পারে। তবে এই সমস্যার উৎকৃষ্ট একটি সমাধান হতে পারে প্রতিদিন রাতে ঘুমানোর পূর্বে একগ্লাস গরম দুধের সাথে মধু ও ইসবগুলের ভুসি মিশ্রিত করে খাওয়া। এছাড়াও আখের রসের সাথে ইসবগুল মিশিয়ে খেলে হাত-পা জ্বালাপোড়া ও মাথাঘোরার মতো সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়।

  • প্রস্রাবের সমস্যা দূর করতে

অনেকেরই প্রস্রাবে সমস্যা থাকে। প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া করা, ইউরিন কম বা বেশি হওয়া অর্থাৎ যেকোনো ধরনের অস্বাভাবিকতা দূর করতে ইসবগুলের ভুসি দারুণ কাজে দেয়।

  • ওজন কমাতে

ওজন কমাতে ইসবগুলের ভুসি হতে পারে দারুণ বিকল্প। খাদ্য গ্রহণের ৩০ মিনিট পূর্বে পানিতে গুলিয়ে ইসবগুলের ভুসি খেলে অন্যান্য খাবারের অতিরিক্ত চাহিদা কমে। যা মানবদেহের অতিরিক্ত চর্বি সংশ্লেষ করতে সাহায্য করে এবং ওজন কমিয়ে ফেলে।

  • যৌনসক্ষমতা বৃদ্ধি

অনেক বিশেষজ্ঞ আছেন যারা যৌনক্ষমতা বাড়ানোর জন্য প্রতি রাতে ঘুমানোর পূর্বে ইসবগুলের ভুসি খেতে বলেন।

 

ইসবগুলের ভুসি খাওয়ার সঠিক নিয়ম

ইসবগুলের ভুসি আমাদের দেহের জন্য অনেক ভালো হলেও মাত্রাতিরিক্ত সেবনে অনেক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। তাই এটি খাওয়ার সঠিক নিয়ম জানা আমাদের সবার জন্যেই জরুরি। বিভিন্ন গবেষণা মতে একটানা ৭-১০ দিনের বেশি খাওয়া উচিৎ না। 

চিকিৎসকদের মতে দিনে এক থেকে দুই চামচ এর বেশি ইসবগুলের ভুসি খাওয়া উচিৎ না। রোগ এবং উদ্দেশ্যের ভিন্নতা অনুযায়ী ইসবগুলের সাথে অন্য পানীয় মিশিয়ে খাওয়া যেতে পারে।

বড় একগ্লাস পানির মধ্যে অর্থাৎ ২৪০ মিলিমিটার পানিতে ২-৩ চা চামচ ইসবগুলের ভুসি আধাঘন্টা যাবৎ ভিজিয়ে খেতে হবে। এবং খাওয়ার আধাঘন্টা আগে খেলে ভালো ফল পাওয়া যায়।

ইসবগুলের ভুসি একধরনের ডায়েটারি ফাইবার। যা অনেক সময় পানিতে দ্রবীভূত হয় আবার অনেক সময় হয় না। অন্ত্রের মধ্যে থাকাকালীন ইসবগুলের ভুসি অনেক পানি শোষণ করে। তাই ইসবগুলের ভুসি খেলে দৈনিক অন্তত ২-৩ লিটার পানি খেতে হবে। ইসবগুলের সাথে লেবুর রস, মধু, দুধ, আখের রস ছাড়াও বিভিন্ন তরল মিশিয়ে খাওয়া যেতে পারে। তবে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।

 

খাওয়ার পূর্বে কিছু সাবধানতা

  • যারা ডায়াবেটিস এর রোগী, অবশ্যই চিনি ছাড়া ইসবগুলের ভুসি খেতে হবে।
  • এলার্জি রোগীদের জন্য এটি না খাওয়াই ভালো।
  • নিম্ন রক্তচাপের রোগীদেরও এটা এড়িয়ে চলা উচিৎ কেননা ইসবগুলের ভুসি রক্তচাপ কমায়।
  • কিডনি রোগীদের ইসবগুলের ভুসি না খাওয়া উত্তম।

 

উপসংহার

ইসবগুলের ভুসি একটি সহজলভ্য এবং প্রাকৃতিক ফাইবার বা আঁশ, যা আধুনিক জীবনযাপনের ক্ষেত্রে শারীরিক বিভিন্ন সমস্যার কার্যকরি সমাধান। মানবদেহের অসংখ্য সমস্যার সমাধানের সহায়ক হতে পারে ইসবগুলের ভুসি। তবে এটি খাওয়ার ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত পানি করার বিষয়টি অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। সঠিক নিয়ম মেনে ইসবগুলের ভুসি খাওয়ার মাধ্যমে দীর্ঘস্থায়ী শারীরিক সুস্থতা ও সুস্থ জীবনযাপন করা অনেক বেশি সহজ হয়ে ওঠে।

Related Posts

যবের ছাতুর উপকারিতা

যবের ছাতু বহু প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের খাদ্যতালিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি বিশেষ করে ভারতীয় উপমহাদেশ এবং মধ্যপ্রাচ্যে প্রচলিত হলেও সময়ের

Read More »
Shopping cart
Sign in

No account yet?

Start typing to see products you are looking for.
Shop
0 Wishlist
0 items Cart
My account