উচ্চ রক্তচাপের কারণ, লক্ষণ ও প্রতিকারের ঘরোয়া উপায়

অসংক্রামক রোগের মধ্যে অন্যতম একটি রোগ হলো উচ্চ রক্তচাপ। এই রোগের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দিক হলো অবস্থা ক্রনিক হওয়ার আগ পর্যন্ত খুব বেশি লক্ষণ পরিলক্ষিত হয় না। আর তাই  পৃথিবী ব্যাপি নিরব ঘাতক হিসেবে পরিচিত উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন।  বর্তমান পৃথিবীর ১৬০ কোটির বেশি মানুষ উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। এবং প্রতিবছর প্রায় ৭০ লাখ মানুষ এই রোগে মারা যাচ্ছে। এক স্বাস্থ্য জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশের প্রাপ্তবয়স্ক দের মধ্যে প্রতি ৪ জনে একজন উচ্চ রক্তচাপের সমস্যায় ভুগছেন। কাজেই এই সমস্যা শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বজুড়ে এক প্রকট সমস্যায় রুপ নিয়েছে। এজন্য শুধু স্বাস্থ্যঝুকি এড়াতে নয়, বরং মৃত্যঝুঁকি এড়ানোর জন্য এই রোগ নিয়ে চাই আমাদের সচেতনতা। সচেতনতার প্রথম ধাপ এই রোগ সম্পর্কে আমাদের বিস্তারিত জানা। তাই আজকের এই ব্লগটি এমনভাবে সাজিয়েছি যেন উচ্চ রক্তচাপ নিয়ে যাবতীয় প্রশ্ন, সন্দেহ সব এক ব্লগেই দূর হয়ে যাবে। উচ্চ রক্তচাপ কি, কেন হয়, প্রাথমিক লক্ষণ এবং ঘরোয়া উপায়ে কিভাবে উচ্চ রক্তচাপ থেকে প্রতিকার পাওয়া যায় তার সবকিছুই জানবো আজকের এই ব্লগে।

উচ্চ রক্তচাপের কারণ, লক্ষণ ও প্রতিকারের ঘরোয়া উপায়

উচ্চ রক্তচাপের কারণ, লক্ষণ ও প্রতিকারের ঘরোয়া উপায়

উচ্চ রক্তচাপ কি?

মানবদেহে রক্ত চলাচলে একটি স্বাভাবিক চাপ রয়েছে।  এই মান টা হলো ১২০/৮০ মিলিমিটার মার্কারী। এই মান এর উপর ভিত্তি করে রক্তচাপ প্রধানত দুই ধরনের। সিস্টোলিক চাপ, ডায়াস্টোলিক চাপ। অর্থাৎ ব্লাড প্রেশার যদি মোটামুটি ১০০ থকে ১৪০ মি.মি মার্কারী এর মধ্যে থাকে, তাহলে তাকে সিস্টোলিক চাপ বলে এবং ৬০ থেকে ৯০ মি.মি. মার্কারী হলে তাকে ডায়াস্টোলিক চাপ বলে। কারো ব্লাড প্রেশার যদি  ১৪০/৯০ বা তার চেয়েও বেশি হয় তাহলে তার উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা রয়েছে বলে ধরা হয়। বয়সের তারতম্যর কারণে এই মান এ কিছুটা ভিন্নতা আসতে পারে এবং একই মানুষের বেলায় বিভিন্ন সময় এটা বিভিন্ন রকম আসতে পারে। মূলত হৃদপিণ্ডের পাম্পিং এর কারণে রক্তচাপ এর সৃষ্টি হয়। ফলে উত্তেজনা, নিদ্রাহীনতা, অধিক পরিশ্রম, দুশ্চিন্তা প্রভৃতি কারণে রক্তচাপ বাড়তে পারে।

 

উচ্চ রক্তচাপে শারীরিক জটিলতা

অনিয়ন্ত্রিত এবং চিকিৎসা বিহীন উচ্চ রক্তচাপ আমাদের দেহে মারাত্মক শারীরিক জটিলতার সৃষ্টি করতে পারে। এক্ষেত্রে শরীরের ৪ টি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে। এগুলো হলো হৃদপিণ্ড, মস্তিষ্ক, কিডনি ও চোখ। রক্তচাপ অনিয়ন্ত্রিত হয়ে গেলে হৃদযন্ত্রের মাংসপেশি দূর্বল হয়ে পড়ে ফলে হৃদপিণ্ড ঠিকমতো রক্ত পাম্প করতে পারে না। এ অবস্থায় হার্ট ফেইলিওর হতে পারে। এবং কখনও কখনও রক্তনালি সংকুচিত হয়ে হার্ট অ্যাটাক কিংবা মায়োকার্ডিয়াল ইনফ্রাকশন হয়। এছাড়াও উচ্চ রক্তচাপে কিডনি তার কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে বিকল হয়ে যায়। চোখের রেটিনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে চোখ পুরোপুরি অন্ধ হয়ে যাওয়া ছাড়াও মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।

উচ্চ রক্তচাপের কারণ

উচ্চ রক্তচাপ আক্রান্ত রোগীকে যাচাই করে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই  কারণ সম্পর্কে জানা যায় না বা সুনির্দিষ্ট করা যায় না। এই অবস্থাকে প্রাইমারি বা এসেন্সিয়াল উচ্চ রক্তচাপ বলে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে উচ্চ রক্তচাপ এর ঝুঁকি ও বাড়তে থাকে তবে কিছু কিছু সুনির্দিষ্ট বিষয় রয়েছে যা উচ্চ রক্তচাপ এর দিকে ধাবিত করে এবং এগুলোকে কারণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়। যেমন:

বংশগত

বংশগত কারণে অনেক সময় উচ্চ রক্তচাপ হয়ে থাকে। বাবা মা থেকে সন্তানসন্ততি তে এই রোগ পৌছায়। এমনকি নিকট আত্মীয় এর কারো উচ্চ রক্তচাপ থাকলেও এ রোগের ঝুঁকি থাকে।

ডায়াবেটিস

ডায়াবেটিস রোগীদের রক্তে ইনসুলিন এর পরিমাণ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে যায় ফলে অথারোসক্লেরোসিস বেশি হয়। এবং বয়সের সাথে সাথে ডায়াবেটিস রোগীদের উচ্চ রক্তচাপ হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। এছাড়াও তারা কিডনির রোগেও আক্রান্ত হতে পারে।

মাত্রাতিরিক্ত লবণ খাওয়া

বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের মতে পূর্ণবয়স্ক একজন ব্যাক্তির দৈনিক ৫ গ্রামের বেশি লবণ খাওয়া উচিৎ নয়। খাবার লবন মুলত সোডিয়াম ক্লোরাইড। যা খাওয়ার পর ভেঙে সোডিয়াম আলাদা হয়ে যায়। এবং সোডিয়াম রক্তের জলীয় অংশের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয় যা রক্তের আয়তন বৃদ্ধি করে। ফলে রক্তচাপ ও বেড়ে যায়।

অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস

অতিরিক্ত চর্বি সমৃদ্ধ খাবার এবং তেলেভাজা খাবার খেলে শরীরের ওজন বেড়ে যায়। এবং রক্তে কোলেস্টেরল এর মাত্রা বাড়তে থাকে। কোলেস্টেরল রক্তনালি মোটা করে দেয়, যা রক্ত চলাচলে বাঁধার সৃষ্টি করে। ফলে হৃদপিণ্ডের সংকোচন প্রসারণ ও বেড়ে যায় এবং রক্তচাপ বেড়ে যায়।

দুশ্চিন্তা

অতিরিক্ত উৎকন্ঠা, রাগ, ক্ষোভ, অভিমান, ভীতি কিংবা উত্তেজনার কারণে রক্তচাপ সাময়িক ভাবে বেড়ে যায়। এই বিষয়গুলো ধারাবাহিক হলে রক্তচাপ স্থায়ীভাবে বাড়তে পারে।

ধুমপান

তামাকের বিভিন্ন ধরনের বিষাক্ত পদার্থের প্রতিক্রিয়া হিসাবে ধুমপায়ীদের উচ্চ রক্তচাপ দেখা দিতে পারে। হৃদপিণ্ডের রোগ ছাড়াও রক্ত পরিবাহী ধমনী ও শিরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। পানের সাথে জর্দা, গুল, তামাকপাতা খেলে একই ধরনের সমস্যা হতে পারে।

অলস জীবনযাপন

ব্যায়াম এবং পরিশ্রম বিহীন শরীরের ওজন বেড়ে যাওয়ার প্রক্রিয়াটা খুবই স্বাভাবিক বিষয়। অতিরিক্ত ওজন এর ফলে হৃদযন্ত্রের পরিশ্রম করতে হয় বেশি। অর্থাৎ হৃদপিণ্ডের পাম্পিং করতে হয় বেশি এবং রক্তচাপ বেড়ে যায়।

মদ্যপান

মদ্যপানে উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি থাকে। অ্যালকোহল এ ক্যালোরির পরিমাণ বেশি থাকায় তা শরীরের ওজন বৃদ্ধিতে ভুমিকা রাখে এবং রক্তচাপ বৃদ্ধিজনিত ফলাফল সহজ করে।

অন্যান্য কারণ

শরীরের বেশ কিছু অঙ্গ আক্রান্ত হলে উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি থাকে। যেমন পিটুইটারি গ্রন্থি এবং এ্যাড্রেনাল গ্রন্থির টিউমার এর কারণে উচ্চ রক্তচাপ হয়। কিডনির রোগ থেকেও রক্তচাপ বৃদ্ধি পায়। এছাড়াও গর্ভধারণ অবস্থায় এ্যাকলাম্পসিয়া বা প্রি এ্যাকলাম্পসিয়া হলে, ব্যাথা নিরাময়ক ওষুধ খেলে, দীর্ঘদিন ধরে জন্ম নিয়ন্ত্রণ এর ট্যাবলেট খেলে উচ্চ রক্তচাপ এর ঝুঁকি বাড়ে।

 

উচ্চ রক্তচাপ এর লক্ষণ

উচ্চ রক্তচাপ এর ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দিক হলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এর লক্ষণ প্রকাশ না হওয়া। অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ শরীরের অন্যান্য অঙ্গ যখন ক্ষতিগ্রস্ত করে ফেলে কিংবা শরীরে অন্যান্য রোগের সুযোগ করে দেয় তখন আমরা হয়তো বুঝতে পারি। তবে বেশকিছু সাধারণ লক্ষণ আছে, যা উচ্চ রক্তচাপ এর কিছুটা হলেও ইঙ্গিত দেয়। যেমন:

  • বমি হওয়া বা বমি বমি ভাব
  • মাথা ঘোড়ানো
  • মাথা গরম হয়ে যাওয়া, মাথা ব্যথা
  • ভালো ঘুম না হওয়া কিংবা নিদ্রাহীনতা
  • অনেক সময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলা
  • অল্পতেই মেজাজ বিগড়ে যাওয়া
  • মাঝে মাঝে কানে শব্দ হওয়া
  • অস্থির হয়ে কাঁপতে থাকা
  • বুকে ব্যাথা
  • চোখে ঝাপসা দেখা
  • ক্লান্তি ও দূর্বলতা

উপরোক্ত লক্ষণগুলি দেকা দিলে কিংবা কোনো প্রকার সন্দেহ জাগলে অবশ্যই রক্তচাপ পরীক্ষা করতে হবে এবং ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ খেতে হবে।

উচ্চ রক্তচাপ প্রতিরোধে কিছু ঘরোয়া উপায়

 

যাদের উচ্চ রক্তচাপ এর সমস্যা রয়েছে তাদের সবসময়ই ওষুধ খেয়ে যেতে হয়। তবে অনেক সময় ওষুধ খাওয়ার পরেও উচ্চ রক্তচাপ কমে না, বা স্বাভাবিক হয় না। তাই উচ্চ রক্তচাপ অনিয়ন্ত্রিত হওয়ার আগেই ঘরোয়া কিছু উপায় এবং জীবনযাপনের অভ্যাস মেনে চলা উচিৎ। যেমন:

 

রিফাইন্ড কার্বোহাইড্রেড এড়িয়ে চলা – ময়দা, চাল, চিনি, প্যাটি, সাদা পাউরুটি, বার্গার এরকম রিফাইন্ড কার্বোহাইড্রেড যত আছে সব পরিত্যাগ করুন। এসবের বিকল্প খাওয়ার অভ্যাস করুন, বিকল্প আশেপাশে না থাকলে একেবারেই পরিহার করুন।

 

অতিরিক্ত লবণ পরিহার – দৈনিক ৫ গ্রামের বেশি লবণ খাওয়া আমাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বৃদ্ধি করে। যাদের উচ্চ রক্তচাপ এর সমস্যা রয়েছে তাদের উচিৎ কাঁচা লবণ একেবারেই পরিহার করা। বাইরের খাবারে লবণের মাত্রা সম্পর্কে আমরা অনিশ্চিত, তাই বাইরের খাবার পুরোপুরি বয়কট করতে হবে।

 

বেশি বেশি পটাশিয়াম গ্রহণ – যাদের উচ্চ রক্তচাপ এর সমস্যা রয়েছে তাদের জন্য পটাশিয়াম অত্যন্ত জরুরি পুষ্টি। কলা তে অধিক পরিমান পটাশিয়াম বিদ্যমান থাকে। তাই নিয়মিত কলা খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন। এছাড়াও এ্যাভোক্যাডো, টমেটো, বাদাম, দই, রাঙা আলু, স্যামন মাছ, টুনা মাছ পটাশিয়াম এর ভালো উৎস হিসেবে খাদ্য তালিকায় নিয়মিত রাখুন।

 

নিয়মিত ব্যায়াম – উচ্চ রক্তচাপ এর ঝুঁকি কমাতে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে নিয়মিত শরীরচর্চা প্রয়োজন। প্রতিদিন অন্ততপক্ষে আধা ঘন্টা শরীর চর্চা করবেন। বেশি বেশি কার্ডিয়ো করার ফলে রক্ত চলাচল বৃদ্ধি পাবে এবং হৃদপিণ্ড সুস্থ থাকবে। দীর্ঘ রোগ এবং হৃদপিণ্ডের রোগের ঝুঁকি কমবে।

 

ধুমপান ও মদ্যপান পরিহার – ধুমপান এবং মদ্যপান উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বাড়ায়। গবেষণা অনুযায়ী অ্যালকোহল প্রায় ১৬ শতাংশ উচ্চ রক্তচাপ এর ঝুঁকি বাড়ায়। এছাড়া সিগারেট এ থাকা নিকোটিন আমাদের রক্তনালির ক্ষতি করে। তাই যত দ্রুত সম্ভব ধুমপান ও মদ্যপানের অভ্যাস পরিহার করতে হবে।

 

স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন – স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের অভ্যাস গড়তে পারলে উচ্চ রক্তচাপ স্বাভাবিক ভাবেই নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। পর্যাপ্ত ঘুম, পর্যাপ্ত পানি খাওয়া, স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া, মানসিক ভাবে নির্ভার থাকা শরীরের অনেক সমস্যা কমিয়ে দিতে পারে।

 

এছাড়াও কোলেস্টেরল মুক্ত জীবন গঠন। কোলেস্টেরল আছে এমন সব খাবার খাদ্যতালিকা থেকে ছেঁটে ফেলা, ফলমূল, শাকসবজি বেশি বেশি খাওয়ার অভ্যাস আমাদের উচ্চ রক্তচাপ মুক্ত একটি জীবন দিতে পারে।

Related Posts

যবের ছাতুর উপকারিতা

যবের ছাতু বহু প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের খাদ্যতালিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি বিশেষ করে ভারতীয় উপমহাদেশ এবং মধ্যপ্রাচ্যে প্রচলিত হলেও সময়ের

Read More »
Shopping cart
Sign in

No account yet?

Start typing to see products you are looking for.
Index
Shop
0 Wishlist
0 items Cart
My account