কৃমি হলো অন্ত্রে বাস করা পরজীবী কীট, যা খাদ্য ও রক্ত শোষণ করে বেঁচে থাকে। সাধারণত অপরিষ্কার খাবার ও পানি, খালি পায়ে হাঁটা এবং ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতার অভাব কৃমি সংক্রমণের প্রধান কারণ।
কৃমি সংক্রমণ হজমে সমস্যা, রক্তস্বল্পতা, পুষ্টির অভাব, ওজন হ্রাস এবং শিশুদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। এটি ত্বকে ফুসকুড়ি, পেটে ব্যথা, ডায়রিয়া ও গ্যাসের সমস্যাও ঘটায়। এর প্রভাবে দীর্ঘমেয়াদে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে যায়।
কৃমি প্রতিরোধে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, সঠিক খাদ্যাভ্যাস, খালি পায়ে হাঁটা এড়ানো এবং নিয়মিত কৃমিনাশক ঔষধ সেবন গুরুত্বপূর্ণ। সচেতনতা এবং সঠিক অভ্যাসের মাধ্যমে কৃমি সংক্রমণ এড়ানো সম্ভব।
Table of Contents
Toggleকৃমির প্রকারভেদ
কৃমি সাধারণত তিন প্রকারের হয়: যেমন-
- রাউন্ডওয়ার্ম (Roundworm):
গোলাকার আকারের এবং অন্ত্রে বাস করে। এটি সাধারণত অ্যাস্কারিস নামে পরিচিত।
- টেপওয়ার্ম (Tapeworm):
ফিতার মতো দীর্ঘাকার এবং অন্ত্রে লেগে থাকে। এটি সাধারণত কাঁচা বা অপরিচ্ছন্ন মাংস খাওয়ার মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে।
- ফ্লুক (Fluke):
পাতা-আকৃতির কৃমি। যা সাধারণত যকৃৎ, ফুসফুস বা রক্তনালিতে বাস করে।
কৃমি কেন হয়?
কৃমি সাধারণত অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ, খাদ্যাভ্যাস এবং অসচেতন জীবনধারার কারণে হয়। প্রধান কারণগুলো হলো:
১. অপরিষ্কার খাদ্য ও পানি গ্রহণ:
- কাঁচা বা আধপাকা খাবার বিশেষ করে মাছ, মাংস বা শাকসবজি খেলে কৃমি হতে পারে।
- দূষিত পানি থেকে কৃমির ডিম বা লার্ভা শরীরে প্রবেশ করে।
২. অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ:
- মলমূত্র ব্যবস্থাপনার অভাব।
- পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাবে কৃমি ডিমের সংক্রমণ ঘটে।
৩. ব্যক্তিগত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাব:
- খাবার খাওয়ার আগে হাত না ধোয়া।
- নখের মধ্যে ময়লা জমা হওয়া।
- খালি পায়ে হাটা।
৪. সংক্রমিত মানুষের সংস্পর্শ:
সংক্রমিত ব্যক্তির মলের মাধ্যমে কৃমির ডিম পরিবেশে ছড়ায়, যা থেকে অন্যরা সংক্রমিত হতে পারে।
৫. কাঁচা বা আধপাকা মাংস খাওয়া:
গরু, শুকর বা মাছের মাংসে থাকা কৃমির ডিম বা লার্ভা পাকস্থলীতে প্রবেশ করে।
৬. পোকামাকড়:
মাছি, তেলাপোকা বা অন্যান্য পোকামাকড়ের মাধ্যমে কৃমির ডিম খাবারে পৌঁছায়।
কৃমি কিভাবে হয়?
কৃমি শরীরে প্রবেশ করে নিম্নলিখিত প্রক্রিয়ায়:
মুখ দিয়ে
কৃমির ডিম বা লার্ভা দূষিত খাবার বা পানির মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে।
ত্বকের মাধ্যমে
কিছু কৃমি যেমন হুকওয়ার্ম মাটিতে খালি পায়ে হাঁটা অবস্থায় ত্বকের ভেতরে প্রবেশ করে।
মশার মাধ্যমে
কিছু কৃমি যেমন ফাইলেরিয়া সংক্রমিত মশার কামড়ের মাধ্যমে রক্তে প্রবেশ করে।
শ্বাসতন্ত্রের মাধ্যমে
বাতাসে মিশ্রিত কৃমির ডিম বা লার্ভা শ্বাসের মাধ্যমে শরীরে ঢুকতে পারে।
পরজীবী পোকা বা জন্তু
সংক্রমিত পোকা বা জন্তুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের মাধ্যমে।
কৃমি হলে কী কী সমস্যা হয়?
কৃমির সংক্রমণ শরীরে বিভিন্ন অংশে সমস্যা সৃষ্টি করে। এটি হালকা থেকে গুরুতর শারীরিক সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। সমস্যাগুলো হল:
১. পুষ্টির অভাব
কৃমি অন্ত্রে থাকা খাদ্য শোষণ করে, ফলে শরীরে পুষ্টির অভাব দেখা দেয়। বিশেষ করে শিশুদের মধ্যে শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি ব্যাহত*/ হয়।
২. রক্তস্বল্পতা
রক্তচোষা কৃমি (যেমন: হুকওয়ার্ম) রক্ত শোষণ করে, যা অ্যানিমিয়া সৃষ্টি করে।
৩. হজমে সমস্যা
কৃমি হলে বিভিন্ন ধরনের হজমজনিত সমস্যা দেখা দেয়। এছাড়াও পেট ব্যথা, বমি বমি ভাব, ডায়রিয়া এবং কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে। পেট ফাঁপা এবং গ্যাসের সমস্যা ও দেখা দেয়।
৪. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস
কৃমিজনিত সমস্যার কারনে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ে, ফলে অন্যান্য সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ে।
৫. ত্বকের সমস্যা
হুকওয়ার্ম বা অন্যান্য কৃমি ত্বকে চুলকানি বা ফুসকুড়ি সৃষ্টি করে।
৬. মানসিকতায় প্রভাব
দীর্ঘস্থায়ী সংক্রমণ থেকে অবসাদ, উদ্বেগ এবং মানসিক দুর্বলতা দেখা দিতে পারে।
৭. যকৃৎ ও অন্যান্য অঙ্গের সমস্যা
ফ্লুক জাতীয় কৃমি যকৃৎ বা ফুসফুসে সংক্রমণ ঘটাতে পারে। এছাড়া যকৃৎ ফুলে যেতে পারে অথবা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
৮. ওজন হ্রাস
পুষ্টি শোষণ হ্রাস এবং হজমের সমস্যার কারণে শরীরের ওজন কমে যায়।
৯. অন্ত্রের বাধা
বড় কৃমি অন্ত্রে জটলা তৈরি করে বাধা সৃষ্টি করতে পারে, যার কারণে শল্য চিকিৎসার প্রয়োজন হয়।
১০. শিশুদের সমস্যা
- শিক্ষার প্রতি আগ্রহ কমে যাওয়া।
- স্মৃতিশক্তি হ্রাস এবং মনোযোগ কমে যাওয়া।
- দীর্ঘস্থায়ী সংক্রমণ থেকে শারীরিক বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়।
কৃমি প্রতিরোধের উপায়
কৃমি সংক্রমণ প্রতিরোধে নিম্নলিখিত ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি:
১. খাবার ও পানির পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করা
- সব সময় সেদ্ধ বা বিশুদ্ধ পানি পান করতে হবে।
- ভালোভাবে ধোয়া এবং রান্না করা খাবার খেতে হবে।
২. ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা রক্ষা করা
- খাওয়ার আগে এবং টয়লেট ব্যবহারের পর হাত ধোয়ার অভ্যাস।
- নখ ছোট রাখা এবং পরিষ্কার রাখা।
৩. পরিবেশ পরিষ্কার রাখা
- বাড়ির আশপাশ পরিষ্কার রাখা এবং পোকামাকড় দমন করা।
- মলমূত্র নিষ্কাশনের সঠিক ব্যবস্থা রাখা।
৪. নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা
বিশেষত শিশুদের নিয়মিত কৃমিনাশক ওষুধ সেবন।
৫.জীবনধারা পরিবর্তন
- খালি পায়ে হাঁটা এড়ানো।
- কাঁচা বা আধপাকা মাংস, মাছ খাওয়া পরিহার করা।
৬. সচেতনতা বৃদ্ধি
কৃমি সংক্রমণ ও তার প্রতিরোধ সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে সচেতন করা।
কৃমি সংক্রমণ একটি সাধারণ কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ জনস্বাস্থ্য সমস্যা। এর প্রধান কারণ হলো অপরিচ্ছন্নতা ও অসচেতনতা। সঠিক পরিচ্ছন্নতা, স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস এবং নিয়মিত কৃমিনাশক ঔষধ গ্রহণ করলে এটি প্রতিরোধ করা সম্ভব। সরকার ও ব্যক্তিগত উদ্যোগের মাধ্যমে এই রোগ নির্মূল সম্ভব।
কৃমি সমস্যা প্রাকৃতিক খাবারসমূহঃ
কিছু প্রাকৃতিক খাবার রয়েছে, যা নিয়মিত খেলে কৃমি সমস্যার সমাধান করা ঘরোয়াভাবেই সম্ভব। নিচে কয়েকটি প্রাকৃতিক খাবারের নাম ও তাদের কার্যকারিতা দেওয়া হলো:
১. রসুন
রসুনে রয়েছে অ্যান্টি-প্যারাসাইটিক বৈশিষ্ট্য যা কৃমি নির্মূলে সহায়ক।
কিভাবে ব্যবহার করবেন:
প্রতিদিন সকালে খালি পেটে ১-২ কোয়া কাঁচা রসুন চিবিয়ে খেতে পারেন।
তাছাড়াও আপনি ফিট ফর লাইফের, গাঁজানো রসুন মধু ও রসুনের আঁচার খাওয়ার মাধ্যমে কৃমি সমস্যা সহ নানাবিধ শারীরিক সমস্যার সমাধান করতে পারবেন।
২. পেঁপে ও পেঁপে বীজ
পেঁপের বীজে পাপেইন নামে এক ধরনের উপাদান থাকে যা কৃমি ধ্বংসে সহায়ক।
কিভাবে ব্যবহার করবেন:
পেঁপে বীজ গুঁড়ো করে পানির সঙ্গে মিশিয়ে সকালে পান করুন।
৩. কুমড়ার বীজ
কুমড়ার বীজে থাকা কুকুরবিটিন কৃমির বিরুদ্ধে কাজ করে।
কিভাবে ব্যবহার করবেন:
কাঁচা কুমড়ার বীজ গুঁড়ো করে দুধ বা পানির সঙ্গে মিশিয়ে খান।
তাছাড়াও আপনি ফিট ফর লাইফের কুমড়ো বড়ি ট্রাই করে দেখতে পারেন।
৪. হলুদ
হলুদে রয়েছে অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি ও অ্যান্টি-প্যারাসাইটিক উপাদান।
কিভাবে ব্যবহার করবেন:
এক গ্লাস গরম দুধে এক চা চামচ হলুদ গুঁড়ো মিশিয়ে রাতে ঘুমানোর আগে পান করুন।
৫. আনারস
আনারসে থাকা ব্রোমেলিন কৃমি ধ্বংস করতে পারে।
কিভাবে ব্যবহার করবেন:
প্রতিদিন এক গ্লাস আনারসের রস পান করুন।
৬. নারকেলের তেল
ভার্জিন গ্রেড নারকেল তেল কৃমি দূর করতে সহায়তা করে।
কিভাবে ব্যবহার করবেন:
খালি পেটে এক চা চামচ নারকেলের তেল খেতে পারেন।
৭. অ্যালোভেরা
অ্যালোভেরার রস কৃমি দূরীকরণে সহায়ক।
কিভাবে ব্যবহার করবেন:
অ্যালোভেরার জেল সংগ্রহ করে তা পানির সঙ্গে মিশিয়ে সকালে পান করুন।
পরামর্শ:
- প্রাকৃতিক খাবার ব্যবহারের পাশাপাশি পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
- কৃমির সমস্যা দীর্ঘস্থায়ী হলে ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করুন।