পৃথিবীতে যেমন ভালো মানুষ রয়েছে, আবার খারাপ মানুষ ও রয়েছে। আমাদের রক্তেও ভালো কোলেস্টেরল এর পাশাপাশি রয়েছে খারাপ কোলেস্টেরল। রক্তে নিয়ন্ত্রিত মাত্রায় থাকলে যার প্রভাব তেমন লক্ষ করা যায় না। কিন্তু কখনও যদি খারাপ কোলেস্টেরল এর মাত্রা বেড়ে যায় দেখা দিতে পারে নানাবিধ শারীরিক জটিলতা। যার শুরুটা হয় উচ্চ রক্তচাপ এর মাধ্যমে, যা প্রভাবিত করে আমাদের হৃদযন্ত্র কে। আমরা বেশিরভাগ মানুষই কোলেস্টেরল নিয়ে উদাসীন। কোলেস্টেরল নিয়ে আমাদের জ্ঞানের পরিধি ই যেখানে সীমাবদ্ধ, সেখানে সচেতনতার প্রশ্ন আসা টা নিতান্তই অমূলক। অথচ সচেতনতার অভাবে অতিরিক্ত কোলেস্টেরল রুপ নিতে পারে মরণঘাতী হিসেবে। তাই আমাদের উচিত কোলেস্টেরল প্রতিহত করার ব্যাপারে সচেতন হওয়া ও সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া।
আজকের ব্লগে কোলেস্টেরল কি এবং ঘরোয়া উপায়ে কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ এর পদ্ধতি জেনে নিবো।
কোলেস্টেরল কি?
কোলেস্টেরল এর অপর নাম হলো লিপিড। যা রক্তের চর্বি বা ফ্যাট হিসেবে পরিচিত। রক্তে সাধারণত দুই ধরনের কোলেস্টেরল থাকে। এইচডিএল বা হাই ডেনসিটি লিপোপ্রোটিন। যাকে আমরা ভালো কোলেস্টেরল হিসেবে চিনি। এলডিএল বা লো ডেনসিটি লিপোপ্রোটিন যা খারাপ কোলেস্টেরল হিসেবে পরিচিত। রক্তে এলডিএল এর পরিমাণ বাড়া মানেই বিপদ আসন্ন। কোলেস্টেরল এর উৎপত্তিস্থল হলো লিভার। লিভার থেকে উৎপত্তি হয়ে কোলেস্টেরল রক্তের সাথে মেশে। কখনও কখনও খাবারের মাধ্যমেও আমাদের শরীরে কোলেস্টেরল প্রবেশ করে। রক্তের সাথে মিশে গিয়ে ব্লকেজ তৈরির মাধ্যমে রক্ত প্রবাহে বাঁধার সৃষ্টি করে। যা হার্ট অ্যাটাক এর কারণ হতে পারে।
রক্তে কোলেস্টেরল বৃদ্ধির কারণ
আমেরিকার ডিজিস কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) এর গবেষণা অনুযায়ী, আমাদের রক্তে কোলেস্টেরল বৃদ্ধির কারণসমূহ হলো অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, অতিরিক্ত ওজন, যথেষ্ট ব্যায়াম না করা, ডায়াবেটিস ইত্যাদি। তবে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের মতামত অনুযায়ী ডায়েট এবং নিয়মিত ব্যায়াম করার পরেও কিছু কারণে আমাদের রক্তে কোলেস্টেরল এর পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে পারে।
বংশানুক্রমিক
আপনার পরিবারের কারো যদি অতিরিক্ত কোলেস্টেরল এর সমস্যা থাকে তাহলে আপনিও ঝুঁকিতে থাকবেন। বিশেষ করে যদি আপনার বাবা মায়ের মধ্যে কারো এই সমস্যা থাকে, তাহলে আপনি উচ্চ ঝুঁকি তে থাকবেন। বয়স ৩০ পার হলেই প্রতিবছর একবার রক্তে কোলেস্টেরল এর মাত্রা পরীক্ষা করুন।
লিঙ্গভেদে
পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের এই রোগের আশঙ্কা বেশি। সিডিসি – ডিজিজ কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন এর মতে মহিলাদের বয়স ৫০ পার হলে বা মেনোপজের পর এই সমস্যা বেশি দেখা দেয়। পুরুষদের রক্তে এইসডিএল এর পরিমাণ বেশি থাকায় তাদের এই ঝুঁকি কম থাকে।
বয়স বৃদ্ধি
বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে এই রোগের আশঙ্কা বৃদ্ধি পায়। কেননা বয়স বেশি হয়ে গেলে আমাদের শরীর রক্ত থেকে খারাপ কোলেস্টেরল বা এলডিএল পুরোপুরি বের করতে পারে না। ফলে রক্তে এলডিএল এর পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে থাকে। তাই নির্দিষ্ট বয়সের পর আমাদের হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়।
ধুমপান ও মদ্যপান
ধুমপান আমাদের রক্তে কোলেস্টেরল এর মাত্রা বাড়িয়ে দেয়, সেইসাথে ফুসফুস এর সমস্যা তো আছেই। একইসাথে এইচডিএল এর পরিমাণ কমে যায়। ফলে আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও হ্রাস পায়। মদ্যপান ‘ট্রাইগ্লিসারাইড’ এর পরিমাণ অনেক বাড়িয়ে দেয়। ট্রাইগ্লিসারাইড স্ট্রোক এর ঝুঁকি বাড়ায়।
অলসতা
যারা কাজের মধ্যে থাকে তাদের শরীরে কোলেস্টেরল বৃদ্ধির আশঙ্কা কম থাকে। অন্যদিকে যারা কায়িক পরিশ্রম করে না, অলস জীবনযাপন করে তাদের রক্তে এইসডিএল কমতে থাকে।
অতিরিক্ত ওজন
যাদের বিএমআই অর্থাৎ বডি মাস ইনডেক্স ৩০ এর উপরে তাদের শরীরে অতিরিক্ত কোলেস্টেরল জমা হওয়ার সুযোগ পায়। ওজন বেশি হলে ভালো কোলেস্টেরল কমতে থাকে। ফলে কোলেস্টেরল জনিত সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়।
এছাড়াও রক্তে কোলেস্টেরল বৃদ্ধি পাওয়ার ক্ষেত্রে খাদ্যভ্যাস একটি বড় কারণ। অস্বাস্থ্যকর খাবার, অতিরিক্ত ফ্যাট এবং ক্যালোরি গ্রহণ রক্তে কোলেস্টেরল এর পরিমাণ বাড়ায়।
কোলেস্টেরল বেড়ে গেলে যেসব লক্ষণ দেখা দেয়
রক্তে কোলেস্টেরল এর পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে দৃশ্যমান তেমন লক্ষণ দেখা যায় না। ধীরে ধীরে তা বিভিন্ন রোগের সৃষ্টি করে। তবে বেশ কিছু উপসর্গ দেখে রক্ত পরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়া যায়। যেমন:
- মাথা ব্যথা: রক্তে কোলেস্টেরল বৃদ্ধি পেলে রক্তনালি আটকে গিয়ে মস্তিষ্কের রক্ত চলাচলে বাধা প্রদান করে। এতে করে ঘাড়ে অস্বস্তিকর ব্যথা অনুভূত হয় এবং মাথা ব্যথা করে।
- চোখের নিচে হলুদাভ: আমরা জানি জন্ডিস হলে চোখের নিচে হলুদ বর্ণ ধারণ করে, তবে কখনও কখনও এটা কোলেস্টেরল বৃদ্ধির সংকেত হতে পারে। চোখের কর্ণিয়ার পাশে ধূসর বর্ণ দেখা যায়।
- হৃৎস্পন্দন বৃদ্ধি : দুশ্চিন্তা বা উৎকন্ঠায় কেবল হৃৎস্পন্দন বৃদ্ধি পায় না। রক্তনালি ব্লক হয়ে পর্যাপ্ত রক্তের সাপ্লাই না পেলে ও হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায়, যা কোলেস্টেরল বৃদ্ধি লক্ষণ।
- পা ব্যথা বা ঠান্ডা হয়ে আসা: অল্প কিছুক্ষণ হাঁটলেই যদি পা দূর্বল হয়ে পড়ে, ব্যথা করে কিংবা বসে বিশ্রাম নিতে গেলে যদি পা ঠান্ডা হয়ে আসছে বলে মনে হয় তাহলে অবশ্যই কোলেস্টেরল পরীক্ষা করা উচিৎ
- চোখের চারপাশে ফোলা ভাব : কখনও কখনও কোলেস্টেরল এর মাত্রা বৃদ্ধি পেলে চোখের চারপাশে দানার মতো মাংসপিণ্ড দেখা যায়। যা সাদা কিংবা হলুদ রঙের হতে পারে।
- নখ হলুদ হয়ে যাওয়া: কখনও যদি আমাদের হাত পায়ের নখ এর উজ্জ্বলতা কমে গিয়ে হলুদাভ বর্ণ ধারণ করে তাহলে বুঝতে হবে কোলেস্টেরল বৃদ্ধি পেয়েছে। কারো কারো ক্ষেত্রে নখের গোড়ার দিকে কালো বা বাদামি দাগ পরিলক্ষিত হয়।
- শরীরে মেদ জমা: শরীরে অতিরিক্ত মেদ জমা কোলেস্টেরল বৃদ্ধির লক্ষণ বহন করে। বিশেষ করে তলপেটের দিকে।
- বিবর্ণ জিভ: কখনও কখনও আমাদের জিভ বিবর্ণ বা ফ্যাকাশে হয়ে যায় এবং ছোট ছোট দানার আবির্ভাব ঘটে। যা কোলেস্টেরল এর লক্ষণ।
এই লক্ষণগুলির কোনোটি দেখা দিলে বা কোনোপ্রকার সন্দেহ জাগলে রক্ত পরীক্ষা করা উচিৎ।
কোলেস্টেরল প্রতিরোধে ঘরোয়া চিকিৎসা
কোলেস্টেরল প্রতিরোধের প্রথম শর্তই হলো স্বাস্থ্যকর খাদ্যভ্যাস এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন। আমাদের খাদ্যতালিকায় বেশকিছু খাবার সংযোজন, বিয়োজন এর মাধ্যমে এবং জীবনযাত্রায় কিছু পরিবর্তন এনে আমরা কোলেস্টেরল প্রতিরোধ করতে পারি।
যেসব খাবার খাবেন
রসুন: এটা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত যে রসুন খারাপ কোলেস্টেরল কমায়। রসুনে রয়েছে প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। দৈনিক এক কোয়া রসুন খেলে কোলেস্টেরল এর মাত্রা ৯ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়।
মেথি : নিয়মিত মেথি চিবিয়ে খেলে কিংবা পানিতে ভিজিয়ে খেলে রক্তে চিনির মাত্রা কমে। যা কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং রোগ জীবাণু ধ্বংস করে।
ধনে: রক্তে এলডিএল এর মাত্রা কমানোর ক্ষেত্রে দারুণ কার্যকরী ধনে। আবার এটি এইচডিএল কোলেস্টেরল ও বৃদ্ধি করে।
আমলকী : আমলকী তে রয়েছে প্রচুর পরিমানে ভিটামিন, অ্যামিনো এসিড এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। যা হৃদযন্ত্র ভালো রাখে। আমলকীর জুস শরীরে কোলেস্টেরল এর মাত্রা কমায়।
গ্রিন টি : গ্রিন টি খেলে মেদ এর কোষে শর্করা প্রবেশ করতে পারে না। যা অতিরিক্ত ওজন প্রতিহত করে। ফলে কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে থাকে।
আদা : আদায় থাকা অ্যান্টিইনফ্লেমেটরি রক্ত জমাটে বাধা দেয়। ফলে হৃদপিণ্ডের রক্ত পাম্পিং স্বাভাবিক থাকে। কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে থাকে।
যা খাবেন না
কোলেস্টেরল বাড়িয়ে দেয় এমন খাবার যেমন রেড মিট, ফাস্টফুড, জাঙ্কফুড সম্পূর্ণ এড়িয়ে চলবেন।
প্রক্রিয়াজাত খাবার যেমন কেক, পেস্ট্রি, পনির, কুকিজ, চিজ, জ্যাম খাদ্যতালিকা থেকে বাদ দিলেই ভালো।
চিনিযুক্ত পানীয় এবং তেলে ভাজা বাইরের সব ধরনের খাবার এড়িয়ে চলবেন। ধুমপান এবং মদ্যপানের অভ্যাস চিরতরে বিদায় করে দিতে হবে।
কোলেস্টেরল বৃদ্ধি এই ব্যাপারটি আপাতদৃষ্টিতে অনেকেই তেমন সমস্যা মনে করেন না, তবে ঠিক সময়ে সচেতন না হলে মারাত্মক প্রাণঘাতী রোগের সৃষ্টি হতে পারে এই অনিয়ন্ত্রিত কোলেস্টেরল। খাদ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে তাই উদাসীন না হয়ে স্বাস্থ্যকর খাবারের সাথে সাথে স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের প্র্যাক্টিস এখন থেকেই শুরু করা উচিৎ।