অশ্বগন্ধার উপকারিতা ও অপকারিতা

প্রাচীন আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় অশ্বগন্ধা একটি পরিচিত নাম। এর বৈজ্ঞানিক নাম Withania Somnifera। আধুনিক বিজ্ঞান অশ্বগন্ধার কার্যকারিতা নিয়ে গবেষণা করেছে এবং এর উপকারিতা সম্পর্কে অনেক তথ্য তুলে ধরেছে। ভারতীয় চিকিৎসা শাস্ত্রের ইতিহাসে অশ্বগন্ধাকে একটি আত্যাশ্চর্য ভেষজ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এটি আয়ুর্বেদে বিশেষভাবে পরিচিত, যেখানে একে অ্যাডাপ্টোজেন বা মানসিক চাপ মুক্তির একটি শক্তিশালী উপাদান হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে।

অশ্বগন্ধার উপকারিতা ও অপকারিতা

অশ্বগন্ধার উপকারিতা ও অপকারিতা

তবে প্রতিটি ভেষজ উপাদানের মতো অশ্বগন্ধারও কিছু উপকারিতা ও অপকারিতা  আছে। আজকের এই ব্লগে আমরা জানব অশ্বগন্ধার উপকারিতা, অপকারিতা এবং এর ব্যবহার সম্পর্কে।

 

অশ্বগন্ধা কি?

অশ্বগন্ধা নামটি সংস্কৃত শব্দ “অশ্ব” অর্থ ঘোড়া এবং “গন্ধ” শব্দের অর্থ গন্ধ বা সুগন্ধি। এই নামকরণের পেছনে দুটি প্রধান কারণ রয়েছে:

অশ্বগন্ধা গাছের শিকড় থেকে এক ধরনের গন্ধ বের হয়, যা অনেকটা ঘোড়ার গন্ধের সঙ্গে মিল আছে বলে মনে করা হয়।

আয়ুর্বেদে বিশ্বাস করা হয় যে অশ্বগন্ধা সেবনের ফলে শরীর ঘোড়ার মতো শক্তি এবং কর্মক্ষমতা লাভ করে। এটি শারীরিক শক্তি বাড়ানোর পাশাপাশি মানসিক দৃঢ়তাও বৃদ্ধি করে।

এই নামটি অশ্বগন্ধার উপকারিতা এবং বৈশিষ্ট্যকে প্রকাশ করে।

 

অশ্বগন্ধা মধ্যে থাকা পুষ্টি উপাদান

অশ্বগন্ধা বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান এবং বায়োঅ্যাকটিভ যৌগ সমৃদ্ধ। এতে থাকা প্রধান পুষ্টি উপাদান এবং বায়োঅ্যাকটিভ যৌগগুলোর তালিকা নিচে দেওয়া হলো:

  • অ্যামিনো অ্যাসিড।
  • আয়রন।
  • ক্যালসিয়াম।
  • অ্যান্টিঅক্সিডেন্টস।
  • ভিটামিন সি।
  • উইথানোলাইডস।
  • ফ্ল্যাভোনয়েডস।
  • স্যাপোনিনস।
  • আলকালয়েডস।
  • ট্যানিনস।

এই পুষ্টি উপাদান ও যৌগগুলো অশ্বগন্ধাকে একটি শক্তিশালী ভেষজ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে, যা শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার জন্য খুবই উপকারী।

 

অশ্বগন্ধার উপকারিতা (Benefits of Ashwagandha)

অশ্বগন্ধা আয়ুর্বেদে বহুল পরিচিত একটি ভেষজ উদ্ভিদ। আধুনিক বিজ্ঞানেও এর কার্যকারিতা প্রমাণিত হয়েছে। নিচে অশ্বগন্ধার প্রধান উপকারিতাগুলো তুলে ধরা হলো:

১. মানসিক চাপ ও উদ্বেগ কমানো

অশ্বগন্ধা একটি প্রাকৃতিক অ্যাডাপ্টোজেন, যা শরীরের স্ট্রেস কমায়। এটি মস্তিষ্কের ভারসাম্য বজায় রাখে, উদ্বেগ হ্রাস করে এবং মানসিক প্রশান্তি নিয়ে আসে।

২. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি

অশ্বগন্ধা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে তোলে। এতে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি উপাদান শরীরকে ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস এবং অন্যান্য ক্ষতিকারক আক্রমণ থেকে রক্ষা করে।

৩. যৌন শক্তি বৃদ্ধি

অশ্বগন্ধা প্রাকৃতিকভাবে যৌন শক্তি বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। অশ্বগন্ধায় থাকা বিশেষ যৌন উদ্দীপক যৌগ শরীরে নাইট্রিক অক্সাইড উৎপাদন বাড়ায়, যা রক্তনালীগুলোকে প্রসারিত করে। এর ফলে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে রক্ত সঞ্চালন বাড়ে এবং যৌন শক্তি বৃদ্ধি পায়। এর মূল উপাদানগুলো শরীরের হরমোন ভারসাম্য বজায় রাখে এবং যৌন জীবনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।

৪.শক্তি এবং স্ট্যামিনা বাড়ানো

অশ্বগন্ধা শরীরে শক্তি এবং স্ট্যামিনা বাড়াতে সহায়ক। এটি ক্লান্তি দূর করে এবং শারীরিক কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করে। প্রাকৃতিক অ্যাডাপ্টোজেন হিসেবে এটি শরীরের সহনশীলতা বাড়ায়, ফলে দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করা যায়। খেলোয়াড়দের জন্য এটি একটি কার্যকর সাপ্লিমেন্ট।

৫. হরমোন ভারসাম্য বজায় রাখা

অশ্বগন্ধা বিশেষভাবে মহিলাদের জন্য হরমোনের ভারসাম্য বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে। এটি পিরিয়ড সংক্রান্ত সমস্যা কমাতে এবং থাইরয়েড হরমোন নিয়ন্ত্রণে রাখতে কার্যকর। অশ্বগন্ধা মহিলাদের পিরিয়ডের সময়ের অসুবিধা যেমন অস্বাভাবিক রক্তস্রাব বা পিরিয়ড ব্যথা হ্রাস করতে সাহায্য করে। এটি থাইরয়েড গ্রন্থির কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে, যা হরমোনের ভারসাম্য বজায় রাখে

৬. ঘুমের সমস্যা দূর

অশ্বগন্ধায় প্রাকৃতিক অ্যাডাপ্টোজেন থাকে, যা মানসিক চাপ কমায়, শারীরিক শান্তি প্রদান করে। ফলে ঘুমের সমস্যা দূর হয়। অশ্বগন্ধা স্ট্রেস হরমোন কর্টিসলের মাত্রা কমিয়ে মস্তিষ্ককে শিথিল করে, যা দ্রুত ঘুমোতে সাহায্য করে। বিশেষ করে যারা নিদ্রাহীনতা বা মানসিক চাপের কারণে ঘুমাতে পারেন না, তাদের জন্য এটি একটি কার্যকর সমাধান।

৭.মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করা

অশ্বগন্ধা নিউরন সুরক্ষায়  এবং মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা উন্নত করতে সাহায্য করে। অশ্বগন্ধা মস্তিষ্কের স্নায়ু ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে, ফলে এটি স্মৃতি এবং মনোযোগ বাড়াতে সাহায্য করে। বিশেষ করে যারা মানসিক চাপ বা স্মৃতির সমস্যায় ভুগেন, তাদের জন্য এটি একটি অত্যন্ত উপকারী উপাদান।

৮.হৃদযন্ত্র ভালো রাখে

অশ্বগন্ধা হৃদযন্ত্র সুস্থ রাখে। অশ্বগন্ধা ক্ষতিকর কোলেস্টেরল (LDL) এবং ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে। এটি হৃদযন্ত্রের সুরক্ষা বাড়ায়, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে এবং হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের ঝুঁকি কমায়

৯. ইনফ্ল্যামেশন কমানো

অশ্বগন্ধার অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি গুণাগুণ শরীরের প্রদাহ কমায়, যা বিভিন্ন ধরনের শারীরিক সমস্যা এবং রোগের জন্য উপকারী। ইনফ্ল্যামেশন শরীরে দীর্ঘকাল ধরে থাকলে এটি বিভিন্ন রোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যেমন- আর্থ্রাইটিস, হৃৎপিণ্ডের রোগ, ডায়াবেটিস এবং অন্য অনেক ক্রনিক রোগ। অশ্বগন্ধা ইনফ্ল্যামেশন কমানোর মাধ্যমে শরীরের স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা বজায় রাখতে এবং দীর্ঘস্থায়ী শারীরিক সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

১০. ক্যান্সার প্রতিরোধ করে

অশ্বগন্ধার মধ্যে থাকা উইথানোলাইডস (Withanolides) শরীরের কোষগুলোর ডিএনএ ক্ষতি প্রতিরোধ করে এবং ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়। এই উপাদানটি অ্যান্টি-টিউমার এবং অ্যান্টি-ক্যান্সার গুণাবলী দ্বারা সমৃদ্ধ, যা শরীরের কোষে সঠিকভাবে কাজ করে এবং অসুস্থ কোষের বৃদ্ধি রোধ করে।

১১.পেশি ও হাড় মজবুত করা

অশ্বগন্ধা পেশি বৃদ্ধিতে এবং হাড়ের ঘনত্ব বাড়াতে সাহায্য করে। এটি বিশেষভাবে শরীরের শক্তি এবং সহনশক্তি বৃদ্ধি করে, যা শারীরিক কর্মক্ষমতা ও শক্তির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিয়মিত অশ্বগন্ধা সেবন হাড় মজবুত করতে এবং পেশি বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।

 

অশ্বগন্ধার অপকারিতা (Side Effects of Ashwagandha)

অশ্বগন্ধা একটি জনপ্রিয় আয়ুর্বেদিক ঔষধি উদ্ভিদ। যা এর বিভিন্ন স্বাস্থ্য উপকারিতার জন্য পরিচিত। তবে ভুল নিয়মে বা  অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে এর কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। তাই ব্যবহারের আগে এই বিষয়গুলো জানা জরুরি:

  • পেটের সমস্যা

অশ্বগন্ধা কারও কারও ক্ষেত্রে বা অতিরিক্ত খাওয়ার ফলে পেটে অস্বস্তি, গ্যাস, ডায়রিয়া বা মলত্যাগে সমস্যা হতে পারে। পেটের সমস্যা থাকলে অশ্বগন্ধা সেবন কমানো উচিত।

  • অতিরিক্ত ঘুম

 অশ্বগন্ধা অতিরিক্ত সেবনে ক্লান্তি ভাব বেড়ে গিয়ে  অতিরিক্ত ঘুম হতে পারে।

  • রক্তচাপ কমানো

অশ্বগন্ধা রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করলেও অতিরিক্ত সেবনে রক্তচাপ অত্যধিক কমে যেতে পারে, ফলে দুর্বলতা বা শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। রক্তচাপ কম থাকলে বিশেষভাবে সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত।

  • হরমোনের সমস্যা

 যারা থাইরয়েড সমস্যা বা প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে সমস্যায় ভুগছেন তারা অতিরিক্ত সেবন এড়িয়ে চলা উচিত।

  • গর্ভাবস্থায় বা স্তন্যদানকালীন সময়ে ব্যবহার

গর্ভাবস্থায় বা স্তন্যদানকালীন সময়ে অশ্বগন্ধা ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকা উচিত। এটি গর্ভাবস্থার ওপর প্রভাব ফেলতে পারে এবং  স্তন্যদানকারী মায়ের জন্য নিরাপদ নয়।অশ্বগন্ধার অনেক উপকারিতা থাকলেও এর মধ্যে থাকা কিছু যৌগ গর্ভপাত ঘটাতে পারে।

  • অ্যালার্জি প্রতিক্রিয়া

 কারও কারও ক্ষেত্রে অশ্বগন্ধা অ্যালার্জি প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। যেমন- ত্বকের র‍্যাশ, চুলকানি বা শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা।

 

অশ্বগন্ধা ব্যবহারের সঠিক পদ্ধতি:

প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য প্রতিদিন ৩০০-৬০০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত নিরাপদ বলে ধরা হয়। তবে চিকিৎসকের পরামর্শে সঠিক ডোজ নির্ধারণ করা উচিত।

  • রাতে ঘুমানোর আগে বা সকালে খালি পেটে খেতে পারেন। তবে প্রথমে কম মাত্রায় শুরু করুন।
  • যদি আপনি কোনো দীর্ঘস্থায়ী রোগে আক্রান্ত হন, তবে অশ্বগন্ধা গ্রহণের আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

 

অশ্বগন্ধা একটি প্রাকৃতিক ঔষধ যা শারীরিক শক্তি বৃদ্ধি, মানসিক চাপ কমানো এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা উন্নত করার মতো বহু উপকারে আসে। এটি আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তবে এটি ব্যবহার করার সময় সঠিক তথ্য জানা এবং সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত। যেহেতু এটি বিভিন্ন হরমোন এবং শারীরিক প্রক্রিয়ার উপর প্রভাব ফেলে, তাই সবার জন্য এটি উপযুক্ত নয়।

যদি এই বিষয় নিয়ে কোন প্রশ্ন থাকে, তাহলে কমেন্টে আমাদের জানান।

Related Posts

Shopping cart
Sign in

No account yet?

Start typing to see products you are looking for.
Shop
0 Wishlist
0 items Cart
My account