বর্তমান সময়ে এমন অসংখ্য মানুষ রয়েছেন যারা আর্থাইটিস বা জয়েন্টের ব্যাথায় আক্রান্ত। একটা গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, এর মূল কারন হচ্ছে আমাদের অস্বাস্থ্যকর লাইফ স্টাইল এবং খাদ্যাভাস। আমরা খুবই আরামপ্রিয়। নিয়মিত শরীর চর্চা করা হয় না। বাজে অস্বাস্থ্যকর খাবার খেতে খেতে যখন একটা সময় বয়স ৩৫-৪০ এ যায় তখনই শুরু হয় এই সমস্যা। এর জন্য মূলত আমরা নিজেরাই দায়ী।
জয়েন্ট বা অস্থিসন্ধির ব্যথা বিভিন্ন কারণে হতে পারে। এই ব্যথা বা আর্থ্রাইটিস যেকোনো বয়সেই হতে পারে তবে এটি প্রধানত ৩৫ থেকে শুরু হয়। এটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বয়স্ক মানুষদের মধ্যে দেখা যায়।
আজকের ব্লগে জয়েন্টের ব্যথা বা আর্থ্রাইটিসের লক্ষণ, কারণ এবং বিভিন্ন ঘরোয়া প্রতিকার সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
আর্থ্রাইটিস বা জয়েন্টে ব্যথা কী?
আর্থ্রাইটিস হলো এমন এক ধরনের সমস্যা যেখানে জয়েন্টগুলোতে প্রদাহ হয়। এছাড়াও এর ফলে ব্যথা, ফুলে যাওয়া এবং কার্যক্ষমতা হ্রাস পায়। এটি প্রধানত দুই ধরনের হয়ে থাকে।
অস্টিওআর্থ্রাইটিস (Osteoarthritis)
এটি সবচেয়ে সাধারণ ধরন, যেখানে জয়েন্টের কার্টিলেজ ক্ষয় হয়।
রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস (Rheumatoid Arthritis)
এটি একটি অটোইমিউন ডিজিজ যেখানে শরীরের ইমিউন সিস্টেম নিজেই জয়েন্টের টিস্যুকে আক্রমণ করে।
জয়েন্টে ব্যথার কারণসমূহ
জয়েন্টে ব্যথা বিভিন্ন কারণে হতে পারে। কিছু সাধারণ কারণ হলো :
কার্টিলেজ ক্ষয়
বয়স বাড়ার সাথে সাথে কার্টিলেজ ক্ষয় হয়ে যায় এবং এই ক্ষয় আর্থ্রাইটিসের মূল কারণ হতে পারে।
জয়েন্টের ইনফেকশন বা প্রদাহ
বিভিন্ন ইনফেকশন যেমন ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া বা ফাঙ্গাসের সংক্রমণ জয়েন্টে প্রদাহের সৃষ্টি করতে পারে।
আঘাত বা ট্রমা
কোনো দুর্ঘটনা বা চোটের ফলে জয়েন্টে ব্যথা হতে পারে।
ওজন বৃদ্ধি
অতিরিক্ত ওজন জয়েন্টের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। যা ব্যথা বা আর্থ্রাইটিসের ঝুঁকি বাড়ায়।
জেনেটিক ফ্যাক্টর
পরিবারের মধ্যে আর্থ্রাইটিসের ইতিহাস থাকলে এর ঝুঁকি বেশি থাকে।
আর্থ্রাইটিসের লক্ষণসমূহ
ব্যথা ও অস্বস্তি
জয়েন্টে ব্যথা সবসময় অনুভূত হতে পারে অথবা তা মাঝে মাঝে হতে পারে।
জয়েন্টে ফুলে যাওয়া
প্রদাহের কারণে জয়েন্ট ফুলে যেতে পারে।
জয়েন্টের হাড়ের ঘর্ষণ
কার্টিলেজ ক্ষয়ের ফলে জয়েন্টের হাড়গুলো একে অপরের সাথে ঘর্ষণ হয়, যা ব্যথার কারণ।
নড়াচড়ায় সীমাবদ্ধতা
জয়েন্টের কার্যক্ষমতা হ্রাস পায়, যা দৈনন্দিন কাজকর্মে বাধা সৃষ্টি করে।
জয়েন্টের চারপাশের ত্বক লাল হয়ে যাওয়া
প্রদাহের ফলে ত্বকের রঙ পরিবর্তিত হতে পারে।
জ্বর
রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসের ক্ষেত্রে শরীরে জ্বর হতে পারে।
আর্থ্রাইটিস বা জয়েন্টে ব্যথার ঘরোয়া সমাধান
এ ধরনের সমস্যায় ঘরোয়া সমাধানগুলো সহজলভ্য, নিরাপদ এবং অনেকাংশে কার্যকরী হতে পারে। জয়েন্টের ব্যথা কমাতে এবং আর্থ্রাইটিসের লক্ষণগুলো হ্রাস করতে কিছু প্রাকৃতিক উপাদান, খাবার, জীবনধারা পরিবর্তন এবং বিশেষ ব্যায়াম সাহায্য করতে পারে। যেমন:
ব্যথা কমাতে প্রাকৃতিক উপাদানের ব্যবহার
আর্থ্রাইটিস বা জয়েন্টের ব্যথা কমাতে বহু ধরনের ভেষজ উপাদান কার্যকরী হয়। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো আদা, হলুদ, মেথি, দারুচিনি এবং মধু ইত্যাদি । এদের ব্যবহারের বিভিন্ন উপায় নিচে দেওয়া হলো।
আদার ব্যবহার
- আদা প্রাকৃতিকভাবে প্রদাহরোধী গুণসম্পন্ন এবং এটি ব্যথা কমাতে সহায়তা করে।
- ব্যবহার পদ্ধতি*: প্রতিদিন ১-২ কাপ আদা চা পান করা বা আদার টুকরা কাঁচা খাওয়া যেতে পারে।
- এছাড়াও, আদার পেস্ট বানিয়ে ব্যথার জায়গায় লাগালে তাৎক্ষণিক আরাম পাওয়া যেতে পারে।
হলুদের ব্যবহার
- হলুদে থাকা কারকিউমিন যৌগ ব্যাথা ও প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে।
- ব্যবহার পদ্ধতি: প্রতিদিনের খাবারে হলুদ ব্যবহার করা যেতে পারে। চাইলে ১ গ্লাস গরম দুধে ১ চা চামচ হলুদ মিশিয়ে পান করা যেতে পারে। এই মিশ্রণটি হলুদ দুধ নামে পরিচিত, যা জয়েন্টের ব্যথা প্রশমনে কার্যকরী।
মেথির ব্যবহার
- মেথিতে ব্যথা প্রদাহরোধী ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট গুণ আছে যা জয়েন্টের ব্যথা কমায়।
- ব্যবহার পদ্ধতি: প্রতিদিন সকালে ১ চা চামচ ভেজানো মেথি খাওয়া যেতে পারে। এছাড়া মেথি গুঁড়ো করে তেল বা পানি মিশিয়ে আক্রান্ত জায়গায় লাগানো যেতে পারে।
দারুচিনি ও মধুর ব্যবহার
- দারুচিনি ও মধুর মিশ্রণ আর্থ্রাইটিসের ব্যথা কমাতে সহায়ক।
- ব্যবহার পদ্ধতি: প্রতিদিন সকালে ১ চা চামচ মধু এবং ১/২ চা চামচ দারুচিনি গুঁড়ো একসঙ্গে মিশিয়ে খাওয়া গেলে ভালো উপকার পাওয়া যায়।
গরম তেল ও সেঁক নেয়া
গরম তেল ব্যথার জায়গায় মালিশ করলে আরাম পাওয়া যায়। এছাড়াও সেঁকের ব্যবহার জয়েন্টের ব্যথা কমাতে প্রাচীনকাল থেকেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। নিচে কিছু জনপ্রিয় পদ্ধতি উল্লেখ করা হলো।
সরিষার তেলের ব্যবহার
- সরিষার তেল জয়েন্টে রক্ত সঞ্চালন বাড়াতে সহায়তা করে এবং জয়েন্টে ব্যথা কমাতে কার্যকর।
- ব্যবহার পদ্ধতি : ১/২ কাপ সরিষার তেল হালকা গরম করে আক্রান্ত জায়গায় মালিশ করুন। চাইলে তেলের সাথে রসুনের পেস্ট মিশিয়ে নিতে পারেন।
ক্যাস্টর অয়েলের ব্যবহার
- ক্যাস্টর অয়েলে থাকা রিকিনোলিক অ্যাসিড ব্যথা প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে।
- ব্যবহার পদ্ধতি: ক্যাস্টর অয়েল গরম করে জয়েন্টে মালিশ করুন। এরপর জায়গাটি গরম কাপড়ে ঢেকে রাখুন।
গরম ও ঠান্ডা সেঁক নেয়া
- গরম সেঁক রক্ত সঞ্চালন বাড়ায়, আর ঠান্ডা সেঁক প্রদাহ এবং ফুলে যাওয়া কমাতে সহায়ক।
- ব্যবহার পদ্ধতি: একটি গরম তোয়ালে বা হিটিং প্যাড ব্যবহার করে আক্রান্ত জায়গায় গরম সেঁক দিতে পারেন। আবার, একটি বরফ প্যাক ব্যবহার করে ঠান্ডা সেঁকও দেওয়া যেতে পারে।
ডায়েট ও পুষ্টিকর খাবার খাওয়া
খাবারের গুণমান জয়েন্টের ব্যথা কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নিচে উল্লেখযোগ্য কিছু উপাদান এবং তাদের ব্যবহার আলোচনা করা হলো।
অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি খাবার খাওয়া
- মাছের তেল, ওমেগা-৩ সমৃদ্ধ খাবার (যেমন সামুদ্রিক মাছ) এবং অলিভ অয়েল খেলে ব্যথা কমাতে সহায়ক হয়।
- সবুজ শাকসবজি, ফল, বাদাম এবং মসুর ডাল অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবার। যা ব্যথা ও প্রদাহ কমায়।
পর্যাপ্ত পানি পান করা
- শরীরে পানির অভাবে জয়েন্টের তরল ক্ষয় হয়, যা ব্যথা বাড়াতে পারে। তাই প্রতিদিন অন্তত ৮-১০ গ্লাস পানি পান করা উচিত।
কোলাজেন সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া
- জয়েন্টের নমনীয়তা বজায় রাখতে কোলাজেন প্রয়োজন। হাড়ের ঝোল, ডিম, এবং বেল পেপারে কোলাজেন থাকে, যা জয়েন্টকে সুস্থ রাখতে সহায়তা করে।
জীবনধারা পরিবর্তন করা
আর্থ্রাইটিস ও জয়েন্টের ব্যথা প্রতিরোধে স্বাস্থ্যকর জীবনধারা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেমন:
ধূমপান ও অ্যালকোহল ত্যাগ করা
ধূমপান ও অ্যালকোহল জয়েন্টের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। তাই এগুলো পরিত্যাগ করা উচিত।
ওজন নিয়ন্ত্রণ করা
অতিরিক্ত ওজন জয়েন্টের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। তাই ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ এবং নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে।
কিছু কাজ এড়িয়ে চলা
ভারী ওজন তোলা, অধিক ঝুঁকে কাজ করা বা অস্বাভাবিকভাবে হাঁটাচলা করা এড়িয়ে চলা উচিত।
যোগব্যায়াম ও স্ট্রেচিং করা
জয়েন্টের নমনীয়তা এবং কার্যক্ষমতা বাড়াতে যোগব্যায়াম এবং স্ট্রেচিং করা কার্যকর ভূমিকা পালন করে।
যোগব্যায়াম করা
যোগব্যায়াম জয়েন্টের নমনীয়তা বাড়াতে সহায়ক। কিছু সাধারণ যোগব্যায়াম হলো বালাসন,, ভুজঙ্গাসন, তাড়াসন এবং ত্রিকোনাসন। এগুলো জয়েন্টের উপর চাপ কমাতে সাহায্য করে এবং ব্যথা কমায়।
স্ট্রেচিং ব্যায়াম করা
- -প্রতিদিন নিয়মিত স্ট্রেচিং করলে জয়েন্টের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং ব্যথা কমে।
- হাত, পা এবং মেরুদণ্ডের জন্য কিছু সহজ স্ট্রেচিং ব্যায়াম জয়েন্টকে সচল রাখতে সহায়ক।
ঘরোয়া প্রতিকার
কিছু সহজ, কার্যকর ঘরোয়া পদ্ধতি আর্থ্রাইটিস বা জয়েন্টের ব্যথা কমাতে সাহায্য করে।
হালকা গরম পানির সেঁক নেয়া
- হালকা গরম পানি ব্যথা কমাতে সহায়ক।
- হালকা গরম পানিতে তোয়ালে ভিজিয়ে আক্রান্ত জায়গায় সেঁক দেওয়া যেতে পারে।
আপেল সিডার ভিনেগার পান করা
- আপেল সিডার ভিনেগারে অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান থাকে।
- ব্যবহার পদ্ধতি: ১ গ্লাস পানির সাথে ১ চা চামচ আপেল সিডার ভিনেগার মিশিয়ে প্রতিদিন পান করা যেতে পারে।
লবণ পানিতে সেঁক নেয়া
- এপসম সল্ট বা ম্যাগনেসিয়াম সালফেট জয়েন্টের ব্যথা কমাতে সহায়ক।
- গরম পানিতে এপসম সল্ট মিশিয়ে এতে হাত বা পা ডুবিয়ে রাখা যেতে পারে। এতে ব্যথা ও ফোলা কমবে।
জয়েন্টের ব্যথা বা আর্থ্রাইটিসের ঘরোয়া সমাধানগুলো সহজলভ্য এবং কম খরচে অনেকাংশে কার্যকর হতে পারে। তবে দীর্ঘস্থায়ী সমস্যার ক্ষেত্রে বা ঘরোয়া প্রতিকার কাজে না লাগলে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। তাছাড়া জীবনধারা পরিবর্তন, পুষ্টিকর খাবার খাওয়া , নিয়মিত ব্যায়াম করা এবং সঠিক যত্ন জয়েন্টের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আজকের এই ব্লগটি পড়ে যদি আপনার কাছে ভালো লাগে তাহলে বলবো FIT FOR LIFE কে ফলো করুন এবং আপনার আপনজনের কাছে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।