হরমোন হলো এক ধরনের কেমিক্যাল ম্যাসেঞ্জার, যা শরীরের কার্যক্রম, গ্রোথ এবং ডেভেলপমেন্টের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি শরীরের বিভিন্ন অংশে সংকেত প্রেরণ করে, যার মাধ্যমে শরীরের সঠিক কাজ নিশ্চিত হয়।
প্রাচীনকালে বয়ঃসন্ধিকালে ছেলে-মেয়েদের আচরণগত পরিবর্তন যেমন- অকারণে আনন্দিত হওয়া বা দুঃখিত হওয়া, মুডের দ্রুত ওঠানামা প্রভৃতি নানা কুসংস্কারের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা হতো। তখন এই পরিবর্তনগুলোকে প্রায়শই অদৃশ্য শক্তি বা কোনো বাহ্যিক কারণের ফল হিসেবে ধরা হতো। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে বিজ্ঞান ও গবেষণার অগ্রগতির ফলে আমরা বুঝতে পেরেছি, বয়ঃসন্ধিকালের এসব আচরণগত পরিবর্তনের আসল কারণ হরমোন।
মানবদেহে বিভিন্ন হরমোন গ্রন্থি রয়েছে, যা শরীরের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ ও সমন্বয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হরমোন গ্রন্থিগুলো হলো- পিটুইটারি, থাইরয়েড, প্যারাথাইরয়েড, থাইমাস, অ্যাড্রেনাল, আইলেটস অব ল্যাংগারহ্যানস এবং গোনাড গ্রন্থি।
শরীরের প্রতিটি ক্রিয়াকলাপেই হরমোনের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তাই হরমোনের ভারসাম্যহীনতা হলে শরীরে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে। কিন্তু কিভাবে বুঝবেন যে, আপনার শরীরে হরমোনের সমস্যা হচ্ছে কি না? নিচে হরমোনের সমস্যা বোঝার কিছু সাধারণ লক্ষণ নিয়ে আলোচনা করা হলো:
১. অতিরিক্ত ক্লান্তি বা দুর্বলতা অনুভব করা
হরমোনের সমস্যার একটি সাধারণ লক্ষণ হলো অতিরিক্ত ক্লান্তি ও দুর্বলতা। শারীরিক পরিশ্রম না করেও যদি সারাদিন আপনার ক্লান্তি অনুভব হয় এবং কাজে মনোযোগ ধরে রাখতে কষ্ট হয়, তাহলে এটি আপনার হরমোনজনিত সমস্যা হতে পারে। সাধারণত থাইরয়েড হরমোনের ভারসাম্যহীনতা বা কর্টিসল হরমোনের মাত্রায় পরিবর্তন হলে এমন সমস্যা দেখা দেয়।
২. হঠাৎ করে ওজন বৃদ্ধি বা কমে যাওয়া
হরমোনের ভারসাম্যহীনতা শরীরের মেটাবলিজমে পরিবর্তন আনে। যা ওজন বেড়ে যাওয়া বা দ্রুত কমে যাওয়ার কারণ। বিশেষ করে থাইরয়েড হরমোনের ভারসাম্য ঠিক না থাকলে শরীরের মেটাবলিজম কমে যায় বা অতিরিক্ত বৃদ্ধি পেতে থাকে, যার ফলে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।
৩. মানসিক চাপ
হরমোনের ভারসাম্যহীনতা মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। বিশেষ করে কর্টিসল হরমোনের মাত্রা বেড়ে গেলে মানসিক চাপ,চিন্তা, এবং মেজাজ খিটখিটে হয়ে ওঠার প্রবণতা দেখা দেয়। কর্টিসলকে স্ট্রেস হরমোন বলা হয়। তবে কর্টিসলের মাত্রা অতিরিক্ত বৃদ্ধি পেলে মস্তিষ্কে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, যা দীর্ঘমেয়াদী মানসিক চাপ ও উদ্বেগের কারণ হতে পারে।
৪. ঘুমের সমস্যা
মেলাটোনিন এবং অন্যান্য হরমোন শরীরের ঘুম নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মেলাটোনিনকে ঘুম হরমোন বলা হয়, কারণ এটি শরীরকে ঘুমানোর জন্য প্রস্তুত করে। যদি মেলাটোনিনসহ অন্যান্য হরমোনের ভারসাম্য বিঘ্নিত হয়, তবে ঘুমাতে অসুবিধা হয়।
রাতের ভালো ঘুম না হওয়া, ঘন ঘন ঘুম ভেঙে যাওয়া বা নির্ধারিত সময়ে ঘুমিয়ে পড়তে না পারা এসবই হরমোনজনিত সমস্যার ইঙ্গিত দেয়া।
৫. ত্বক ও চুলের সমস্যা
হরমোনের ভারসাম্যহীনতা ত্বক ও চুলের স্বাস্থ্যের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। হরমোনের সমস্যা হলে ত্বক রুক্ষ যায়, অতিরিক্ত ব্রণ দেখা দেয় বা অযাচিত তেলতেলে ভাব সৃষ্টি হয়। সাধারণত অ্যান্ড্রোজেন হরমোনের মাত্রা বেড়ে গেলে ব্রণ এবং ত্বকের তেলতেলে ভাব বৃদ্ধি পায়। এ ছাড়া এস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন হরমোনের মাত্রা পরিবর্তনের ফলে ত্বকের আর্দ্রতা কমে যেতে পারে। যা ত্বককে রুক্ষ ও প্রাণহীন করে তোলে।
চুলের ক্ষেত্রেও হরমোনের ভারসাম্যহীনতা নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। অতিরিক্ত চুল পড়া হরমোনজনিত সমস্যার অন্যতম লক্ষণ ।
৬. হজমের সমস্যা
কর্টিসল, ইনসুলিন এবং থাইরয়েড হরমোনের ভারসাম্য বিঘ্নিত হলে হজমে নানা ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। এর ফলে অতিরিক্ত গ্যাস, পেট ব্যথা, বদহজম বা কোষ্ঠকাঠিন্যের মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে। কর্টিসল হরমোনের মাত্রা বাড়লে শরীরের স্ট্রেস বৃদ্ধি পায়। যা হজম প্রক্রিয়ায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা সৃষ্টি করে।
এছাড়া প্রোজেস্টেরন ও ইস্ট্রোজেনের তারতম্যের কারণেও হজমের গতি ধীর হতে পারে, যা কোষ্ঠকাঠিন্যের মতো সমস্যা বাড়ায়। হরমোনের ভারসাম্য ঠিক রাখা তাই শুধু মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য নয়, হজম ব্যবস্থার সঠিক কার্যকারিতা নিশ্চিত করতেও গুরুত্বপূর্ণ।
৭. যৌন আকাঙ্ক্ষা হ্রাস
হরমোনের ভারসাম্যহীনতা বা অসামঞ্জস্যতার কারণে শরীরে নানা ধরনের পরিবর্তন ঘটে, যার মধ্যে যৌন আকাঙ্ক্ষা কমে যাওয়া অন্যতম প্রধান সমস্যা।
হরমোনগুলো আমাদের শরীরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে। যেমন- প্রজনন প্রক্রিয়া, মেজাজ ঠিক রাখা, শক্তির মাত্রা এবং অন্যান্য শারীরিক কার্যক্রম। প্রোজেস্টেরন, ইস্ট্রোজেন, টেস্টোস্টেরন এবং থাইরয়েড হরমোনের তারতম্য যৌন আকাঙ্ক্ষায় প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষ করে মহিলাদের ক্ষেত্রে প্রোজেস্টেরন এবং ইস্ট্রোজেনের পরিবর্তন গর্ভাবস্থা, মেনোপজ বা মাসিক চক্রের সময় যৌন আকাঙ্ক্ষায় হ্রাস ঘটাতে পারে। পুরুষদের ক্ষেত্রে টেস্টোস্টেরনের স্বল্পতা যৌন আকাঙ্ক্ষা কমিয়ে দেয়।এমন পরিস্থিতিতে হরমোনের ভারসাম্য বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
হরমোনজনিত সমস্যা যতই সাধারণ মনে হোক না কেন, তা অবহেলা করা উচিত নয়। শরীরের স্বাভাবিক কার্যক্রম সঠিক রাখতে হরমোনের ভারসাম্য বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
হরমোনের সমস্যার লক্ষণগুলো সম্পর্কে সচেতন থাকুন। কোনো লক্ষণ দেখলে নিজেই অনুমান না করে ডাক্তারের পরামর্শ নিন। এই বিষয়ে আরও জানতে হলে আমাদের ব্লগ পোস্টগুলো নিয়মিত ফলো করুন এবং আপনার কোনো প্রশ্ন থাকলে নিচে কমেন্ট করতে ভুলবেন না।