বর্তমান পৃথিবীতে ডায়াবেটিস কতটা ব্যাপক আকার ধারণ করেছে এটা বোঝার জন্য আমাদের কিছু পরিসংখ্যান দেখে নেওয়া জরুরী। বিশ্বে বর্তমানে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা ৫৩৭ মিলিয়ন অর্থাৎ ৫৩ কোটি ৭০ লক্ষ। যেখানে বাংলাদেশেই এই সংখ্যা ১ কোটি ৩১ লক্ষ। ২০৪৫ সালে এই সংখ্যাটা গিয়ে দাঁড়াবে ২ কোটি ২৩ লক্ষ তে। বাংলাদেশে যেসব সংক্রামক রোগে মানুষ মারা যাচ্ছে তার ১০% ই মারা যাচ্ছে ডায়াবেটিস এর কারণে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী এটা স্পষ্ট যে বর্তমান সময়ে ডায়াবেটিস কতটা হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে! অথচ এই রোগ নিয়ে নেই আমাদের পর্যাপ্ত জ্ঞান ও সচেতনতা। তাই ডায়াবেটিস কি এবং ডায়াবেটিস হলে কি কি সমস্যা হয় তার সবটা জানবো আজকের এই ব্লগে।
ডায়াবেটিস কি?
ডায়াবেটিস একটি দীর্ঘস্থায়ী রোগ। যখন শরীরে ইনসুলিন উৎপাদন হয়না বা শর্করার পরিমাণে তারতম্য ঘটে তখনই ডায়াবেটিস দেখা দেয়। আমাদের রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করাই হলো ইনসুলিন এর প্রধান কাজ। আমাদের খাবার থেকে চিনি বা শর্করা (গ্লুকোজ) রক্তের মাধ্যমে কোষে বহন করে নিয়ে যায় ইনসুলিন। পরবর্তীতে কোষ শরীরের প্রয়োজনীয় শক্তির জন্য গ্লুকোজ ব্যবহার করে। অগ্ন্যাশয় এর বিশেষ কোষ দ্বারা গঠিত হরমোন আইলেটস থেকে ইনসুলিন তৈরী হয়। এই ইনসুলিন এর তারতম্যের কারনেই আমাদের রক্তে শর্করার পরিমাণে তারতম্য ঘটে ফলে ডায়াবেটিস হয়।
ডায়াবেটিস এর ধরন
ডায়াবেটিস দুই ধরনের:
১) টাইপ – ১
২) টাইপ – ২
টাইপ-১ ডায়াবেটিসে অগ্ন্যাশয় থেকে ইনসুলিন উৎপাদন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় এবং টাইপ-২ ডায়াবেটিসে অগ্ন্যাশয় যথাযথভাবে ইনসুলিন উৎপাদন করতে পারে না।
ডায়াবেটিস এর কারণে সৃষ্ট প্রধান সমস্যা
ডায়াবেটিস এমন একটি রোগ যা মানবদেহে অন্যান্য রোগের বিস্তার সহজ করে দেয়। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য যেমন:
১) হাইপোগ্লাইসেমিয়া (রক্তে শর্করার মাত্রা কমে যাওয়া)
ডায়াবেটিস রোগীরা অনেক সময় ঔষধের অতিরিক্ত ডোজ বা খাবার গ্রহণের সূচী না মানার কারণে হাইপোগ্লাইসেমিয়ার শিকার হন। এর ফলে মাথা ঘোরা, দুর্বলতা, কাঁপুনি এবং অজ্ঞান হওয়ার মতো উপসর্গ দেখা দিতে পারে।
২) হাইপারগ্লাইসেমিয়া (রক্তে শর্করার মাত্রা বেড়ে যাওয়া)
অপর্যাপ্ত ইনসুলিন ব্যবহার বা অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যগ্রহণের কারণে মাঝেমধ্যে রক্তে শর্করার মাত্রা বেড়ে যেতে পারে। এটি শরীরে অতিরিক্ত পিপাসা, প্রস্রাবের পরিমাণ বৃদ্ধি এবং ক্লান্তির কারণ হতে পারে।
৩) হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বৃদ্ধি
ডায়াবেটিস হৃদরোগের প্রধান কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম। এটি উচ্চ রক্তচাপ এবং কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়, যা রক্তনালীতে প্লাক জমে যাওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়। যার ফলে হার্ট অ্যাটাক এবং স্ট্রোকের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। ডায়াবেটিস আক্রান্ত ব্যক্তিদের হৃদরোগের ঝুঁকি সাধারণ মানুষের চেয়ে প্রায় দুই থেকে চার গুণ বেশি থাকে।
৪) কিডনি রোগ
দীর্ঘমেয়াদি ডায়াবেটিস কিডনির রক্তনালী ক্ষতিগ্রস্ত করে, ফলে নেফ্রোপ্যাথি বা কিডনি বিকল হয়ে যেতে পারে। এক্ষেত্রে কিডনি বিকল হলে ডায়ালাইসিস বা কিডনি প্রতিস্থাপনের মতো বড় চিকিৎসার বিকল্প থাকে না।
৫) নিউরোপ্যাথি বা স্নায়ুতন্ত্রের সমস্যা
দীর্ঘদিন ধরে ডায়াবেটিস থাকলে স্নায়ুতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। বিশেষ করে হাত-পা, আঙুল এবং পায়ের আঙ্গুলে ঝিনঝিনে ভাব, অসাড়তা বা ব্যথা সৃষ্টি করে। নিউরোপ্যাথি শরীরের অন্যান্য অঙ্গের কার্যকারিতা ব্যাহত করে। এছাড়াও পায়ের সংক্রমণ বা ঘা হতে পারে যা কখনও কখনও শারীরিক অঙ্গচ্ছেদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
৬) রেটিনোপ্যাথি এবং চোখের সমস্যা
ডায়াবেটিস রেটিনার ছোট রক্তনালীকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে, যার ফলে দৃষ্টিশক্তি হ্রাস পায়। কখনো কখনো অন্ধত্ব দেখা দিতে পারে। এছাড়া ডায়াবেটিস আক্রান্ত ব্যক্তিদের গ্লুকোমা এবং ক্যাটারাক্টের ঝুঁকিও বেশি থাকে।
৭) গ্যাস্ট্রোপেরেসিস
ডায়াবেটিসের কারণে পেটের মধ্যে থাকা খাবার হজম হতে সময় বেশি লাগে। এর ফলে বমি, পেট ব্যথা এবং হজমের সমস্যা দেখা দিতে পারে। এটি ওষুধের কার্যকারিতায়ও প্রভাব ফেলে।
৮) ত্বকের সমস্যা
ডায়াবেটিস রোগীদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের ত্বকের সংক্রমণ যেমন- ব্যাকটেরিয়াল এবং ফাঙ্গাল ইনফেকশন দেখা যায়। ডায়াবেটিস হলে ত্বকের শুষ্কতা ও চুলকানি হতে পারে। যা কখনো কখনো ত্বকে ফাটল সৃষ্টি করে এবং সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ায়।
৯) দাঁত ও মুখের সমস্যা
ডায়াবেটিস দাঁত ও মাড়ির সংক্রমণকে বাড়িয়ে দিতে পারে। মাড়ির প্রদাহ (পেরিওডেন্টাল ডিজিজ) ডায়াবেটিস রোগীদের মধ্যে বেশি দেখা যায় এবং এটি দাঁত হারানোর কারণ হতে পারে। মুখে শুষ্কতা ও ছত্রাকজনিত ইনফেকশন (ক্যান্ডিডিয়াসিস) হতে পারে ডায়াবেটিস এর কারণে।
১০) ডায়াবেটিক কিটোএসিডোসিস (DKA)
*টাইপ-১ ডায়াবেটিস এর ক্ষেত্রে সাধারণত দেখা যায় রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে না থাকলে শরীরে কিটোন জমে যায়। ফলে এটি রক্তকে অম্লীয় করে তোলে। এটি এমন একটি সংকটজনক অবস্থা যা দ্রুত চিকিৎসা না করলে মৃত্যুর ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
১১) যৌন সমস্যা
ডায়াবেটিস নার্ভ এবং রক্তনালীর ক্ষতি করতে পারে। যা পুরুষদের মধ্যে ইরেক্টাইল ডিসফাংশন এবং মহিলাদের মধ্যে যৌন ইচ্ছা হ্রাস, অস্বস্তির কারণ হতে পারে।
১২) হজমে সমস্যা
ডায়াবেটিসের কারণে অন্ত্রে নার্ভের ক্ষতি হলে ডায়রিয়া, কোষ্ঠকাঠিন্য এবং হজমের সমস্যা দেখা দিতে পারে।
১৩) অপ্রত্যাশিত ভাবে ওজন হ্রাস বা বৃদ্ধি
ডায়াবেটিস রোগীদের মধ্যে অপ্রত্যাশিতভাবে ওজন কমে বা বেড়ে যেতে পারে। ইনসুলিনের কার্যকারিতা ব্যাহত হলে শরীরের ওজনের পরিবর্তন ঘটে।
১৪) মূত্রনালীর সংক্রমণ (UTI)
ডায়াবেটিস রোগীদের মূত্রনালীর সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি। এতে প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া, ঘন ঘন প্রস্রাবের চাপ এবং প্রস্রাবে রক্তের উপস্থিতি দেখা দিতে পারে।
১৫) রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস
ডায়াবেটিস রোগীদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া। ফলে খুব সহজেই অন্য রোগব্যাধি শরীরে বাসা বাঁধতে পারে।যেমন- সর্দি, জ্বর বা ফ্লুর মতো সংক্রমণ।
১৬) মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা
ডায়াবেটিসের কারণে বিষণ্ণতা, উদ্বেগ এবং মানসিক চাপ বেশি পরিলক্ষিত হয়। ডায়াবেটিস এর ফলে দীর্ঘমেয়াদি মানসিক চাপ রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।