স্বাস্থ্য সচেতনতার ক্ষেত্রে পুরুষরা অনেক বেশি উদাসীন হয়ে থাকে। তাদের শারীরিক সমস্যার প্রতি খেয়াল প্রায়শই উপেক্ষিত হয়। এটার অন্যতম কারণ হলো পুরুষেরা তাদের ছোটখাটো অসুস্থতাকে গুরুত্ব দেওয়া বা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করাকে এক ধরনের দুর্বলতা ভাবেন। পুরুষ মানে শক্তিশালী, পুরুষ মানে কর্মঠ, পুরুষ মানে ছোটখাটো অসুস্থতায় কাবু হোন না, এরকম একটা মিথ আমাদের প্রচলিত সমাজের বিশ্বাসের জায়গায় খুব ভালোভাবেই জেঁকে বসেছে। আর এভাবে পুরুষেরা শক্তিশালী থাকার চাপে নিজেদের শারীরিক সমস্যাকে গুরুত্ব না দিয়ে এগিয়ে চলেন সামনের দিকে। কিন্তু এই অবহেলা একসময় জন্ম দিতে পারে বড় ধরনের জটিলতার। পুরুষদের এরকম বেশ কিছু শারীরিক সমস্যা রয়েছে, যা সময়মতো নজর দিতে পারলে বড় ধরনের বিপদ হওয়া থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
আজকের এই ব্লগে আমরা পুরুষদের এমনকিছু শারীরিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা করবো, যা কখনোই অবহেলা না করে শুরুতেই গুরুত্বের সাথে দেখা উচিত এবং ডাক্তার পরামর্শ অনুযায়ী যথাযথ চিকিৎসা করানো উচিত।
১) প্রস্টেট গ্রন্থির বৃদ্ধি : প্রস্টেট হলো পুরুষের মূত্রনালী কে ঘিরে রাখা সুপারির মতো একটি মাংসপিণ্ড বা গ্রন্থি। এটি শুধুমাত্র পুরুষের শরীরেই থকে। বিভিন্ন কারণে এই গ্রন্থি বৃদ্ধি পেতে পারে। এই গ্রন্থিটির বৃদ্ধিজনিত ফলাফল শরীরে বেশকিছু জটিলতায় জন্ম দেয় যেমন : প্রস্রাবে জ্বালা-পোড়া, প্রস্রাব কম হওয়া ইত্যাদি। ঠিক সময়ে চিকিৎসা না করালে এটি কিডনি রোগের কারণ পর্যন্ত হতে পারে। অতিরিক্ত বৃদ্ধি পেলে ডাক্তাররা অপারেশন করে এই গ্রন্থিটি কেটে ফেলার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। সঠিক চিকিৎসা না করা হলো এটি মূত্রনালীকে চেপে ধরে প্রস্রাব চলাচলে বিঘ্ন ঘটায়, এবং কিডনির সেরাম ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা অতিরিক্ত পরিমাণে বাড়িয়ে দেয়। ফলে কিডনি বিকল হওয়া থেকে শুরু করে আরো বড় ধরনের রোগ শরীরে বাসা বাঁধতে থাকে । তাই প্রস্টেট গ্রন্থির বৃদ্ধি কখনোই অবহেলা করা উচিত না।
২) গোপনাঙ্গে গাঁট : গোপনাঙ্গ নিয়ে যেকোনো ধরনের সমস্যা আমরা অবহেলা করি কিংবা ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে দ্বিধাবোধ করি। কিন্তু এটা মোটেই উচিৎ না। যদি কখনও দেখতে পান আপনার গোপনাঙ্গে গাঁট দেখা দিয়েছে, তাহলে তা একদমই অবহেলা করবেন না। এটি এক ধরনের ক্যান্সারের পূর্ব লক্ষণ হতে পারে। ১৫-৪৯ বছরের যুবকদের মধ্যে মূলত টেস্টিক্যুলার ক্যান্সারের লক্ষণ দেখা যায় । প্রতিবছর প্রায় ৩ হাজার এর বেশি পুরুষ এরকম সমস্যা নিয়ে ডাক্তারের শরণাপন্ন হন। আবার অনেকে ব্যাপারটি বুঝতেই পারেন না বা অবহেলা করেন। কেননা এই রোগে অন্ডকোষে ব্যথা হতেও পারে নাও পারে। কিন্তু আকারে যদি কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় তাহলে দেরি না করে অনতিবিলম্বে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।
৩) ঘন ঘন প্রস্রাব : একজন পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তির দৈনিক ৪ – ৮ বার প্রস্রাব হওয়াটা স্বাভাবিক। দৈনিক ৮ বারের বেশি প্রস্রাব হলে সেটা কে ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া বলে। বয়সের ভিন্নতার কারণে প্রস্রাবের পরিমাণ এ তারতম্য হওয়াটা স্বাভাবিক। তবে কম হোক বেশি হোক, ঘন ঘন প্রস্রাব, প্রস্রাবে অনেক বেগ আসা, কিংবা শৌচাগারে পৌঁছানোর আগেই কাপড় নষ্ট হওয়া ‘প্রস্টেইট’ গ্রন্থির তীব্র সমস্যার লক্ষণ। যা থেকে প্রস্টেইট ক্যান্সার হতে পারে। ডায়াবেটিস ছাড়াও রক্তে পটাশিয়াম বা ক্যালসিয়াম এর তারতম্য, মূত্রথলীর স্নায়ুবিকলতা, স্ট্রোক ও অন্যান্য স্নায়ুরোগ, মূত্রনালী বা মূত্রথলীর সংক্রমণ, মস্তিষ্কের টিউমার, মূত্রথলীর ক্যান্সার, সার্জারি, আঘাত, কিডনি রোগ, বিকিরণ, মূত্র নিয়ন্ত্রক এডিওউচ হরমোনের অভাব বা অকার্যকারীতা, থাইরয়েড বা করটিসল হরমোনের আধিক্য প্রভৃতি কারণে ঘন ঘন প্রস্রাব হয়ে থাকে। তাই উপর্যুক্ত লক্ষণ দেখা দিলে যথাযথ পরীক্ষার মাধ্যমে রোগ নির্নয় করে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
৪) ইরেকটাইল ডিসফাংশন : ইরেকটাইল ডিসফাংশন বা যৌন ক্ষমতা কমে যাওয়া পুরুষদের মাঝে খুবই সাধারণ একটি সমস্যা এবং বয়োবৃদ্ধির সাথে সাথে এই রোগের পরিমাণ অনেক বেড়ে যায়। “জার্নাল অব সেক্সুয়াল মেডিসিন” এর গবেষণা মতে চল্লিশে পা দেওয়ার আগেই প্রতি ৪ জন পুরুষের মধ্যে একজন ইরেকটাইল ডিসফাংশন রোগে ভোগেন। শুধু বয়স নয়, দুশ্চিন্তা, অবস্বাদগ্রস্থতা, ডায়াবেটিস, কিডনি, হৃদরোগ ইত্যাদি পুরুষের যৌনসক্ষমতা কমিয়ে দেয়।
৫) বুকের ব্যথা : আমাদের একটি ভ্রান্ত ধারণা হলো বুকে মানেই হৃদরোগের সাথে সংশ্লিষ্টতা। আবার এটাও ভেবে থাকি বয়োবৃদ্ধরাই কেবল হৃদরোগে আক্রান্ত হয়। কিন্তু বুকে ব্যথা হৃদরোগ ছাড়াও আরো অনেক রোগের লক্ষণ হতে পারে। নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্ট বা ফুসফুসের পীড়া প্রভৃতি রোগের পূর্বলক্ষণ হতে পারে বুকে ব্যথা। অতিরিক্ত মানসিক চাপ বুকে ব্যথার জন্ম দেয়। এছাড়াও আমাদের অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস এর ফলে সৃষ্ট অতিরিক্ত এসিড নির্গমন কিংবা আলসারে আক্রান্ত হলে বুকে ব্যথা অনুভূত হয়। এজন্য বুকে ব্যথা হলে তা কখনোই এড়িয়ে যাওয়া উচিত নয়।
৬) পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলে ব্যথা : পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলে ব্যথা হলে গেঁটে বাতের লক্ষণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। নারী পুরুষ সবারই এই সমস্যা হলেও, নারীদের তুলনায় এটি প্রায় তিনগুণ বেশি দেখা যায় পুরুষদের মধ্যে। প্রতি ৭ জন পুরুষের মধ্যে একজন এই সমস্যায় ভুগে থাকেন। হাড়ের জোড়ায় ব্যথা কেই মূলত গেঁটে বাত বলা হয়ে থাকে যা পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলেই বেশি হয়। শরীরে ইউরিক অ্যাসিড তৈরী হওয়ার কারণে রক্ত ও হাড়ের জোড়ার চারপাশে সোডিয়াম সালফেট এর স্ফটিক জমা হতে থাকে। ফলে রক্ত চলাচলে বাঁধার কারনে এই সমস্যার সৃষ্টি হয়। সঠিক সময়ে চিকিৎসকের পরামর্শ না নিলে এই রোগ মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে এবং হাড়ের জোড়া স্থায়ীভাবে নষ্ট করে দিতে পারে।
৭) ক্ল্যামিডিয়া ও গনোরিয়া : সাধারণত পুরুষের পুরুষাঙ্গ একই সময় ক্ল্যামিডিয়া ও গনোরিয়া রোগে আক্রান্ত হতে পারে। পুরুষাঙ্গ থেকে অতিরিক্ত পরিমাণে ক্ষরণ এবং মূত্রত্যাগে যন্ত্রণা এই রোগের প্রধান লক্ষণ। গড়ে প্রায় ৫০ শতাংশ পুরুষ এই রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। তাই এই রোগের ঝুঁকি অনেক বেশি। সঠিক সময়ে চিকিৎসা না করালে খুব সহজেই অন্যান্য যৌনরোগ বাসা বাঁধে এবং শরীরের সকল অঙ্গ-পতঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে।
৮) ম্যান বুবস্ : পুরুষের স্তন অস্বাভাবিক বড় হওয়া টা মূলত তিনটা সমস্যা ইঙ্গিত করে। প্রথমত : অতিরিক্ত ওজন। দ্বিতীয়ত : এক ধরনের হরমোনাল রোগ, যা মূলত গাইনাকোমাস্টিয়া নামে পরিচিত। ছেলেদের ক্রোমোসোম হরমোন টেস্টোস্টেরন ও ইস্ট্রোজেন এর ভারসাম্য নষ্ট হলে এই সমস্যা দেখা দেয়। তৃতীয়ত : যকৃতের সমস্যা। যকৃতের সমস্যা হলেও হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট হয়। এছাড়াও বয়স্কদের ম্যান বুবস্ হওয়া টা অন্ডকোষ সমস্যার লক্ষণ ও হতে পারে। তাই এই অস্বাভাবিকতা মোটেই অবহেলার নয়।
৯) ঘ্রাণশক্তি হ্রাস : ঘ্রাণশক্তি হ্রাস হওয়াকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় “অ্যানোসমিয়া” বলে। এই রোগটি স্থায়ী বা অস্থায়ী হতে পারে। তবে পুরুষের শরীরে এই রোগের উপস্থিতি অন্য বেশকিছু রোগের বিস্তার ত্বরান্বিত করে। ঠান্ডা বা এলার্জি সমস্যা থেকে নাকের আবরণে যন্ত্রণা অনুভূত হয় এবং গন্ধের অনুভূতি শক্তি অস্থায়ীভাবে অকার্যকর হয়ে পড়ে। মারাত্মক কিছু স্বাস্থ্য সমস্যার কারণে স্থায়ীভাবে অ্যানোসমিয়া হতে পারে। এই রোগ পর্যায়ক্রমে ক্ষুধা কমে যাওয়া, পুষ্টির ঘাটতি, শক্তি কমে যাওয়া ছাড়াও নানাবিধ জটিলতার জন্ম দেয়। অ্যানোসমিয়া রোগ স্নায়ুবিক সমস্যা, ভাইরাসজনিত রোগ এবং অন্তঃস্রাবী গ্রন্থির সমস্যাগুলোকে নির্দেশ করে। তাই এই রোগ নিয়ে শুরুতেই সচেতন হওয়া উচিত।
১০) ক্লান্তি অনুভব করা : পরিসংখানে দেখা যায় বেশিরভাগ পুরুষ খুব অল্পতেই ক্লান্ত হয়ে যায় বা শারীরিক দূর্বলতা অনুভব করে। CFS (Chronic Fatigue Syndrome) একটি সাধারণ রোগ যা থেকে ক্লান্তি লাগতে পারে। অনেকসময় সারারাত ঘুমিয়েও সকালে ক্লান্তি দূর হয় না। ঠিক কি কারণে ‘সিএফএস’ হয় তা নির্ধারণ করা কঠিন তবে হরমোনের ভারসাম্যহীনতা, ভাইরাসের সংক্রমণ, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া কিংবা প্রচন্ড উদ্বেগ বা মানসিক চাপ থেকে শরীরে ক্লান্তি অনুভূত হয়। অর্থাৎ আপাতদৃষ্টিতে শরীরে ক্লান্তি খুবই সাধারণ কিছু মনে হলেও, হতে পারে কোনো বড় ধরনের রোগ। তাই এমন অস্বাভাবিকতা পরিলক্ষিত হলে ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হওয়া উচিত।
পরিশেষে বলা যায়, পুরুষদের শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাগুলোকে মোটেই অবহেলার চোখে দেখা উচিত নয়। পর্যাপ্ত ধারণার অভাব কিংবা ছোটখাটো রোগ বলে এড়িয়ে যাওয়া রোগ গুলোই একসময় হতে পারে মৃত্যুর কারণ। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণের অভ্যাস পুরুষদের দীর্ঘমেয়াদী সুস্বাস্থ্য নিশ্চতকরণে কার্যকারী ভূমিকা পালন করে। তাই শারীরিক এবং মানসিক ছোটখাটো লক্ষণগুলো গুরুত্ব সহকারে নিয়ে সময়মত চিকিৎসা করানোই হতে পারে পুরুষের সুস্থ ও দীর্ঘ জীবনযাপন মূল চাবিকাঠি।