হাঁপানির কারণ, লক্ষণ ও প্রতিকার

একটি তথ্য দিয়ে শুরু করি। “বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় অবস্থিত জাতীয় বক্ষব্যাধী ইন্সটিটিউটের তথ্য মতে জাতীয় বক্ষব্যাধী হাসপাতালে যে পরিমাণ রোগী চিকিৎসা নিতে আসেন, তাদের ৩০ শতাংশ রোগী ই হাঁপানি রোগী। আর এই সংখ্যাটা প্রতিবছরই বৃদ্ধি পাচ্ছে।” এই রোগটি শুধু বাংলাদেশেই নয়, পুরো পৃথিবী ব্যাপি ক্রমবর্ধমান একটি রোগ হিসেবে পরিচিত। বর্তমান পৃথিবীজুড়ে প্রায় ৩০ কোটির বেশি মানুষ হাঁপানি রোগে আক্রান্ত এবং ধারণা করা হচ্ছে ২০২৫ সাল নাগাদ এই সংখ্যাটা ৪০ কোটিতে পৌঁছাবে। যার প্রায় ৩৫ শতাংশই শিশু। এই পরিসংখ্যানই বলে দেয় কতটা গুরুতর ভাবে ছড়িয়ে পড়েছে এই রোগ। আমরা অনেক সময়ই সাধারণ সমস্যা ভেবে তেমন গুরুত্ব দিই না। ফলে দীর্ঘস্থায়ী সমস্যার সাথে সাথে জীবন হয়ে উঠতে পারে দূর্বিসহ। তাই এই বিষয়ে সচেতন হওয়া এখন সময়ের দাবী।

হাঁপানির কারণ, লক্ষণ ও প্রতিকার

হাঁপানির কারণ, লক্ষণ ও প্রতিকার

কাজেই আজকের ব্লগে আমরা আলোচনা করবো হাঁপানি রোগ কেন হয়, সঠিক কারন, লক্ষণ এবং হাঁপানি প্রতিকারের উপায়।

হাঁপানির রোগের  কারণ:

হাঁপানি রোগের প্রধান কারণ ২ টি।

১) এটোপি বা বংশগত (Genetic) এবং ‘এলার্জি’ পরিবেশগত উপাদান

২) শ্বাসনালীর অতি-সক্রিয়তা (Bronchial hyper-responsiveness)

৬৫ শতাংশ রোগী এলার্জির কারণে হাঁপানিতে আক্রান্ত হয়। যুবক অবস্থায় হাঁপানি তে আক্রান্ত হওয়ার হার ১৫%। পেশাগত বা অন্যান্য কারণে “Potent Sensitizer” সংস্পর্শে আসা মানুষের ১৫-২০% হাঁপানি তে আক্রান্ত হয়ে থাকে।

এর বাইরে ও হাঁপানির আর ও অনেক কারণ রয়েছে। সুনির্দিষ্ট করে সব কারণ উল্লেখ সম্ভব নয়। কারন হাঁপানির এ্যাটিওলজি এখনও গবেষণা চলছে। তবে আরও কিছু কারণ রয়েছে যা হাঁপানির বিকাশে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে।

স্থূলতা

যাদের ওজন অতিরিক্ত বা স্থূল তাদের হাঁপানি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। কিংবা অতিরিক্ত ওজন এর ব্যক্তিদের হাঁপানির লক্ষণগুলো দিন দিন খারাপ হতে থাকে। অবশ্য এরজন্য নিম্নমানের জীবনযাত্রা ও দায়ী। এই জীবনযাত্রা ওষুধের কার্যকরী ক্ষমতায় বাধা দান করে।

এলার্জি

হাঁপানির জন্য মূলত ‘মাইট’ নামে এক ধরনের কিট দায়ী। মাইট মানুষের শরীরে প্রবেশ করে এলার্জি বাড়ায় যা একসময় হাঁপানি তে পরিণত হয়। হাঁপানি তে আক্রান্ত ব্যাক্তির এটোপিক ডার্মাইটিস (একজিমা) অথবা এলার্জিক রাইনাইটিস ( খড় জ্বর) হওয়ার সম্ভাবনা থাকে প্রবল।

ধূমপান

ধূমপান হাঁপানির অন্যতম কারণ। ধূমপায়ী ব্যক্তিরা হাঁপানির উচ্চ ঝুঁকিতে থাকে। ধূমপান শ্বাসনালী তে জ্বালাপোড়ার সৃষ্টি করে।

বেশিরভাগ সময়ই আমরা অনেক রোগ শুরু থেকে বুঝতে পারি না। ফলে চিকিৎসা নিতে নিতে দেরি হয়ে যায়। যা স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। তাই যেকোনো রোগের লক্ষণ জানা অতীব জরুরি।

হাঁপানি রোগের লক্ষণ

কাশি

কাশি হাঁপানির সবচেয়ে সাধারণ লক্ষণ। ধুলাবালি, দূষিত পরিবেশ থেকে এসব মাইক্রো পার্টিকেল আমাদের শ্বাসনালী তে প্রবেশ করে তখনই জ্বালাপোড়া এবং প্রদাহের সৃষ্টি হয়। যা স্নায়ুকে উদ্দীপ্ত করে মস্তিষ্কে সংকেত পাঠায় এবং কাশির মাধ্যমে ফুসফুস থেকে বাতাস বের হয়।

সাঁ সাঁ আওয়াজ

হাঁপানি তে শ্বাসনালী তে প্রদাহের কারনে শ্বাসপ্রশ্বাস এর সময় বেশ কষ্ট হয়। বুকে চাপ অনূভুত হয় এবং টান বাড়ে। বাতাস পুরোপুরি মুক্ত না হওয়ায় নিঃশ্বাস নেওয়ার সময় সাঁ সাঁ টাইপ আওয়াজ হতে থাকে।

দ্রুত শ্বাসপ্রশ্বাস নেওয়া

হাঁপানির কারণে শ্বাসকষ্ট হয়। ফলে আক্রান্ত ব্যাক্তি দ্রুত শ্বাসপ্রশ্বাস নিতে বাধ্য হন।

দীর্ঘস্থায়ী কাশি

যারা শ্বাসকষ্টে ভোগেন তাদের কাশি সহজে যায় না এবং শীতকালে এর প্রবণতা বাড়তেই থাকে। হাঁপানির কারণে হওয়া তীব্র কাশির সমস্যা কে কফ-ভ্যারিয়্যান্ট অ্যাজমা বলে।

এছাড়াও দম বন্ধ লাগা, নাকে মুখে ধুলাবালি গেলে শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাওয়া, বুকে ব্যথা, নিদ্রাহীনতা, দূর্বলতা ইত্যাদি হাঁপানির লক্ষণ।

হাঁপানি রোগের প্রতিকার ব্যবস্থা

হাঁপানি রোগ হলে বেশ কয়েক স্তরের প্রতিকার ব্যবস্থা রয়েছে। চিকিৎসক নির্দেশিত দীর্ঘমেয়াদী হাঁপানির চিকিৎসা, দ্রুত উপসমের চিকিৎসা এবং কিছু প্রাকৃতিক ঘরোয়া প্রতিকার ব্যবস্থা রয়েছে।

দীর্ঘমেয়াদী হাঁপানির চিকিৎসা

হাঁপানি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য এবং প্রতিরোধ ব্যবস্থা হিসাবে দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসার অংশ হিসাবে রয়েছে বেশকিছু ওষুধ। ইনহেলড কর্টিকোস্টেরয়েড যেমন: মোমেটাসোন, ফ্লুটিকাসোন, সাইক্লেসোনাইড এবং বুডেসোনাইড। এসব ওষুধ শ্বাসনালী তে বাধা নিয়ন্ত্রণ করে। লিউকোট্রিন মডিফায়ার যেমন জাফিরলুকাস্ট, মন্টেলুকাস্ট ইত্যাদি।দীর্ঘস্থায়ী বিটা অ্যাগোনিস্ট (LABA) যেমন: Salmeterol এবং Formoterol শ্বাসনালী কে প্রসারিত করে প্রায় ১২ ঘন্টার জন্য শোথ কমাতে সাহায্য করে।

দ্রুত উপশমের চিকিৎসা

দ্রুত উপশমের ওষুধগুলি রেসকিউ ইনহেলার নামে পরিচিত। হাঁপানির তাৎক্ষণিক লক্ষণ উপশম এর জন্য ডাক্তাররা বিটা-অ্যাগোনিস্টগুলি আগে সাজেস্ট করেন। এর মধ্যে রয়েছে এপিনেফ্রিন ( Asthmanefrin, Primatene Mist), লেভালবুটেরল ( Xopenex HFA), এবং অ্যালবুটেরল ( Proventil HFA, ProAir HFA, Ventolin HFA)। এছাড়াও মিথাইলপ্রেডনিসোলন, প্রেডনিসোন হলো মুখের কর্টকোস্টেরয়েডের দুটি নাম যা তাৎক্ষণিক শ্বাসনালীর শোথ কমায় এবং ইপ্র্যাট্রোপিয়াম ( Atrovent) একটি অ্যান্টিকোলিনার্জিক ওষুধ যা বন্ধ থাকা শ্বাসনালী খুলে দেয়।

প্রাকৃতিক ঘরোয়া প্রতিকার ব্যবস্থা

সঠিক ওষুধ, পর্যাপ্ত খাবার হাঁপানির রোগের প্রবণতা কমাতে পারে। তবে এর বাইরেও নেওয়া যেতে পারে কিছু ঘরোয়া প্রতিকার ব্যবস্থা। যেমন :

  • ভিটামিন – সি এবং বিটা ক্যারোটিন সমৃদ্ধ খাবার খেলে হাঁপানির উপসর্গ কমতে পারে।
  • দই এবং কিসমিসের মতো গাঁজনযুক্ত খাবার থেকে পাওয়া প্রোবায়োটিক গুলো শ্বাসনালীর প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে।
  • গবেষণা অনুযায়ী রসুন, আদা এবং ওমেগা-৩এস তেল হাঁপানিতে সাহায্য করতে পারে।
  • মধু এমন একটি উপকারী উপাদান যা হাঁপানি রোগীদের শ্বাসপ্রশ্বাস সহজ করে দেয়।
  • ইউক্যালিপটাসের তেল, ল্যাভেন্ডার তেল হাঁপানি কমাতে দারুণ কার্যকর ভূমিকা রাখে।
  • হলুদের ফাইটোক্যামিকেল উপাদান কারকিউমিন হাঁপানি কমাতে তাৎক্ষণিক থেরাপি হিসেবে খুবই উপকারী। যা চা কিংবা গরম পানিতে গুঁড়া মিশিয়ে খাওয়া যেতে পারে।
  • এছাড়াও আদা চা এবং কফি তে হাঁপানি রোগীরা আরাম পান।

হাঁপানিতে প্রতিবছর প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষ মারা যায় এবং যার প্রায় ৮০ শতাংশই তৃতীয় বিশ্বের। বাংলাদেশ যেহেতু তৃতীয় বিশ্বের একটি উন্নয়নশীল দেশ, হাঁপানি রোগ নিয়ে এই অঞ্চলের মানুষের তাই আরো বেশি সচেতনতা প্রয়োজন।

Related Posts

Shopping cart
Sign in

No account yet?

Start typing to see products you are looking for.
Shop
0 Wishlist
0 items Cart
My account