সিস্ট শব্দটির সাথে আমরা সবাই কমবেশি পরিচিত। বিশেষ করে মহিলাদের ক্ষেত্রে সিস্ট এর কথা বেশি শোনা গেলেও নারী পুরুষ সবার শরীরেই সিস্ট হতে পারে। অনেকেই ব্যাপারটা কে আতঙ্কের সাথে দেখেন। তবে সিস্ট ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রেই বিনাইন বা ক্যান্সারহীন। অর্থাৎ ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই কম। তবে শরীরে সিস্ট হলে স্বাভাবিক কাজে কিছু সমস্যা হতে পারে।
আজকের ব্লগে আমরা জানবো সিস্ট কি এবং শরীরের কোথাও সিস্ট হলে কি ধরনের সমস্যা হতে পারে তা নিয়ে।
সিস্ট কি?
সিস্ট হলো এক ধরনের পানিভর্তি থলে। এতে পরিষ্কার, ঘোলা, সংক্রমিত রক্ত বা হলদে রঙের পানি থাকতে পারে। সিস্ট বলতে অনেকে টিউমার বুঝে থাকেন, তবে টিউমার মানে কিন্তু ক্যান্সার নয়। শরীরে কোনোকিছু জায়গা দখল করলে সেটাকে টিউমার বা স্পেস অকুপায়িং লিসান বলে। সিস্ট এর দেয়াল মোটা হলে তাতে অনেক পার্টিশন থাকে। পার্টিশন কোথাও মোটা বা কোথাও পাতলা হতে পারে। সিস্টের মধ্যে মাংসপিণ্ড ও থাকতে পারে। সিস্টের মধ্যে পুরোনো রক্ত বা খয়েরী রঙের পদার্থ থাকতে পারে (চকোলেট সিস্ট)। সাধারণ পানি থাকলে সিম্পল সিস্ট আর রক্তে থাকলে হেমারেজিক সিস্ট বলে।
সিস্ট এর প্রকারভেদ
সিস্ট বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে এবং এদের প্রভাব ও ভিন্ন। এর মধ্যে কিছু উল্লেখযোগ্য সিস্ট এর ধরণ হলো:
- ডার্ময়েড সিস্ট: সাধারণত চামড়ায়, মুখমণ্ডলে এবং মাথায় হয়।
- ডিম্বাশয়ের সিস্ট: এটি ডিম্বাশয়ে দেখা যায় এবং বিশেষ করে মহিলাদের মধ্যে বেশি হয়।
- পাইলনিডাল সিস্ট: মেরুদণ্ডের নিচের অংশে দেখা যায়, এটার উপস্থিতি ব্যথার সৃষ্টি করে।
- বেকারের সিস্ট: হাঁটুর পেছনে দেখা যায় এবং স্বাভাবিক ভাবেই চলাচলের সময় ব্যথা অনুভূত হয়।
- কিডনির সিস্ট: কিডনিতে তরল ভর্তি এক ধরনের ফোস্কা দেখা দেয়। এটি মূত্রনালীর ক্ষতি করতে পারে
- লিভারের সিস্ট: লিভারেও সিস্ট হতে পারে এবং এক্ষেত্রে লিভারের কার্যকারিতা কমে যায়।
সিস্ট হলে যেসব সমস্যা হতে পারে
১) ব্যথা বা অস্বস্তি
- সিস্ট অনেক সময় সংক্রমণ বা ইনফ্লেমেশন (প্রদাহ) তৈরি করে, যার কারণে ব্যথা হতে পারে।
- আকারে বড় সিস্ট বা সিস্টের স্থানে চাপ পড়লে প্রায়শই অস্বস্তি অনুভূত হয় এবং দৈনন্দিন কাজকর্মে অসুবিধা সৃষ্টি করে।
২) অঙ্গের কার্যকারিতা ব্যাহত হওয়া
- সিস্ট যদি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে দেখা যায়, যেমন- কিডনি, লিভার বা ব্রেন। তবে তা অঙ্গের কার্যক্ষমতা কমিয়ে দিতে পারে বা বাধাগ্রস্ত করতে পারে।
- কিডনিতে সিস্ট থাকলে শরীরে উৎপাদিত রাসায়নিক বর্জ্য ফিল্টারিং প্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টি হতে পারে। যা কিডনি ফেইলিওরের ঝুঁকি বাড়ায়।
৩) বৃদ্ধি ও চাপ সৃষ্টি
সিস্ট যদি বড় হতে থাকে, তবে এটি আশেপাশের টিস্যুতে চাপ সৃষ্টি করে। বিশেষ করে, ডিম্বাশয়ের সিস্ট বড় হলে আশেপাশের অঙ্গগুলোর ওপর চাপ পড়ে। এর কারণে মৃদু থেকে তীব্র ব্যথা ও অস্বস্তির কারণ হতে পারে।
৪) রক্তক্ষরণ বা হেমারেজ
- কিছু সিস্ট ফেটে গেলে রক্তক্ষরণ হতে পারে। এটি শরীরের বিভিন্ন স্থানে হতে পারে এবং সেই অনুযায়ী ঝুঁকি কম বেশি হয়।
- বিশেষত ডিম্বাশয়ের সিস্টে রক্তক্ষরণ হলে তলপেটে তীব্র ব্যথা অনুভূত হয় এবং ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ এর সম্ভাবনা থাকে। পরবর্তীতে সংক্রমণ পুরো শরীরে ছড়িয়ে যেতে পারে।
৫) সংক্রমণ ও পুঁজ জমা হওয়া
- সিস্ট সংক্রমিত হলে মাঝে মাঝে এটি অ্যাবসেসে পরিণত হতে পারে, যার মধ্যে পুঁজ জমে যায়।
- সংক্রমিত সিস্টে ব্যথা এবং ফোলাভাব দেখা দেয়। এছাড়াও আক্রান্ত স্থানে লালচে ভাব দেখা যায়। পরবর্তীতে এটি আরও বড় সংক্রমণের কারণ হতে পারে।
৬) হরমোনাল ভারসাম্যহীনতা
- বিশেষ করে ডিম্বাশয়ের সিস্ট হরমোনাল ভারসাম্যহীনতার প্রধান কারণ। এর ফলে মাসিক চক্র অনিয়মিত হতে পারে এবং বিভিন্ন ধরনের হরমোনাল অসামঞ্জস্য দেখা দেয়।
- এটি মহিলাদের মধ্যে পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম (PCOS) এর ঝুঁকি বাড়ায় এবং শারীরিক বৃদ্ধি ব্যাহত করে।
৭) শ্বাসকষ্ট ও ফুসফুসের কার্যকারিতা হ্রাস
ফুসফুসের সিস্ট শ্বাসকষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। এটি ফুসফুসের কার্যক্ষমতা কমিয়ে দেয় এবং শরীরের অক্সিজেন সরবরাহে বাঁধার সৃষ্টি করে।
৮) ক্যান্সারের ঝুঁকি বৃদ্ধি
- যেসব সিস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে সেগুলো ম্যালিগন্যান্ট হিসেবে পরিচিত। তবে ৯০ শতাংশ সিস্ট ই বিনাইন বা ক্যান্সারহীন। তবে কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে, যেমন কিডনি বা ডিম্বাশয়ের সিস্টে ক্যান্সারের ঝুঁকি থাকতে পারে।
- বায়োপসি করলে বোঝা যায় সিস্ট টি ক্যান্সার প্রকৃতির কিনা।
৯) পেশি ও নার্ভে চাপ সৃষ্টি
বড় সিস্ট পেশি এবং নার্ভের উপর চাপ সৃষ্টি করে। বিশেষ করে স্পাইনাল সিস্ট হলে মেরুদণ্ডে সমস্যা দেখা যায়। যা পিঠে ব্যথা এবং দুর্বলতার অন্যতম কারণ।
১০) হাঁটাচলায় অসুবিধা
হাঁটু বা পায়ের পেছনে যদি সিস্ট গঠিত হয় তাহলে হাঁটাচলায় সমস্যা হয় এবং দীর্ঘক্ষণ দাঁড়ানো কষ্টকর হয়ে পড়ে।
১১) মাথাব্যথা ও মানসিক সমস্যার সৃষ্টি
মস্তিষ্ক কিংবা মাথায় কোন স্থানে সিস্ট হলে মাথাব্যথা, মানসিক চাপ, স্মৃতিশক্তি বা মনোযোগে ঘাটতি দেখা দিতে পারে।
যেসব সিস্ট থেকে ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি থাকে সেগুলো বেশিরভাগই শক্ত এবং ছড়িয়ে পড়ার আগে তেমন ব্যথা অনুভূত হয় না। অন্যদিকে সিম্পল সিস্ট থাকে নরম এবং এতে ব্যথাও অনুভূত হয়। তাই সিস্ট হলেই ভীত হতে হবে, অপারেশন করতে হবে এই ধারণা থেকে বের হতে হবে। আতঙ্কিত হয়ে ছোট এবং সিম্পল সিস্ট গুলো অপারেশন করতে গেলে ক্ষতি আরো বেশি হতে পারে। কিন্তু কিছু সিস্ট এর বেলায় অপারেশন জরুরি হতে পারে। সেক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শ ও সম্ভাবনা অনুযায়ী যথাযথ চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিৎ।