রক্তে হিমোগ্লোবিন কমে গেলে মানবদেহে নানা ধরণের শারীরিক ও মানসিক সমস্যা সৃষ্টি হয়। কারণ এটি রক্তে অক্সিজেন পরিবহন করে যা প্রতিটি কোষে পৌঁছানো খুবই জরুরি। হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কমে গেলে (যাকে সাধারণত এনিমিয়া বলা হয়) শরীরের বিভিন্ন সিস্টেমের উপর বিরূপ প্রভাব পড়ে।
রক্তে হিমোগ্লোবিন কমে গেলে কি কি সমস্যা হয়?
এখানে রক্তে হিমোগ্লোবিন কমে গেলে কী কী সমস্যা হয় তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেওয়া হলো।
১. শারীরিক দুর্বলতা ও ক্লান্তি
অক্সিজেন সরবরাহ কমে গেলে মাংসপেশিগুলো যথেষ্ট শক্তি পায় না এবং এর ফলে শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে। কোষে পর্যাপ্ত অক্সিজেন না পৌঁছানোর ফলে শরীর কার্যক্ষমতা হারায়। কাজকর্মে মনোযোগ কমে যায় এবং সামান্য কাজ করলেও খুব ক্লান্তি অনুভূত হয়।
২. শ্বাসকষ্ট ও হৃদস্পন্দন বৃদ্ধি
যেহেতু হিমোগ্লোবিনের কাজ হলো শরীরে অক্সিজেন সরবরাহ করা, এর অভাবে শ্বাসকষ্টের সমস্যা দেখা দেয়। বিশেষ করে সামান্য শারীরিক কার্যক্রমেও শরীরে অক্সিজেনের চাহিদা পূরণে কষ্ট হয়, ফলে শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত হয় এবং হৃদস্পন্দন বাড়ে। অতিরিক্ত কাজের ফলে হৃদযন্ত্রে চাপ সৃষ্টি হয়, যা পরবর্তীতে হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
৩. মাথা ঘোরা ও মাথাব্যথা
হিমোগ্লোবিনের অভাবে মস্তিষ্ক পর্যাপ্ত অক্সিজেন পায় না। এর ফলে মাথা ঘোরা এবং মাথাব্যথা হয়। যা একসময় অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার কারণ হতে পারে। মাইগ্রেনের প্রবণতা বাড়তে পারে এবং দীর্ঘমেয়াদে মানসিক স্বাস্থ্যেও এর বিরূপ প্রভাব পড়ে
৪. ত্বকের রং ফ্যাকাশে হওয়া
হিমোগ্লোবিন রক্তে লোহিত কণিকা বা আরবিসি (RBC) তৈরি করে, যা ত্বককে স্বাভাবিক রং প্রদান করে। হিমোগ্লোবিন কমে গেলে ত্বক ফ্যাকাশে ও বিবর্ণ হয়ে যায়। কারণ রক্তে হিমোগ্লোবিনের অভাব হলে ত্বকে পর্যাপ্ত রক্ত পৌঁছায় না, ফলে ত্বক উজ্জ্বলতা হারায়।
৫. ঠান্ডার অনুভূতি বেশি হওয়া
রক্তে হিমোগ্লোবিন কম থাকলে রক্ত সঞ্চালনে ব্যাঘাত ঘটে, যা শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে সমস্যা সৃষ্টি করে। ফলে ঠান্ডা আবহাওয়ায় শরীর গরম রাখতে কষ্ট হয় এবং শরীরে শীতের অনুভূতি বেশি হয়। বিশেষ করে হাত পা ঠান্ডা হয়ে যায়। শরীরের উষ্ণতা বজায় রাখতে না পারলে এর ফলে বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে।
৬. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হওয়া
হিমোগ্লোবিনের অভাবে শরীরে প্রয়োজনীয় পুষ্টির অভাব হতে পারে, যা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। এই অবস্থায় শরীর সহজেই সংক্রমণ এবং বিভিন্ন রোগের শিকার হতে পারে। সাধারণ সর্দি-কাশি বা ইনফেকশন দ্রুত সংক্রমণ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে এবং দীর্ঘস্থায়ী সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
৭. কাজকর্মে মনোযোগের অভাব ও স্মৃতিশক্তির সমস্যা
হিমোগ্লোবিনের অভাবে মস্তিষ্ক সঠিকভাবে কাজ করতে পারে না, যার ফলে মনোযোগ কমে যায় এবং স্মৃতিশক্তি দুর্বল হয়। রক্তে পর্যাপ্ত হিমোগ্লোবিন না থাকলে মানুষের চিন্তা করার ক্ষমতা ও শেখার ক্ষমতা কমে যায় এবং সহজেই ভুলে যাওয়ার প্রবণতা দেখা দেয়।
৮. ঘুমের সমস্যা
হিমোগ্লোবিনের ঘাটতি দেখা দিলে রাতের ঘুমে ব্যাঘাত ঘটে এবং ঘুম গভীর হয় না। অনেক সময় হিমোগ্লোবিন কম থাকার কারণে ঘুমের মধ্যে শ্বাসকষ্টের সমস্যা দেখা দিতে পারে, যা ঘুমের সমস্যা তৈরি করতে পারে। এতে দিনের বেলায় ক্লান্তি ও অবসাদ বেশি অনুভূত হয়।
রক্তে হিমোগ্লোবিন কমে যাওয়ার বিশেষ কারণসমূহ:
হিমোগ্লোবিন কমে যাওয়ার পিছনে বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে। এর মধ্যে সাধারণ কারণগুলো হলো:
- আয়রন বা লৌহের অভাব: আয়রন হিমোগ্লোবিন তৈরির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আয়রনের ঘাটতি হলে হিমোগ্লোবিনের উৎপাদন কমে যায়।
- ভিটামিন বি১২ বা ফলিক এসিডের অভাব: এই দুই ভিটামিন রক্ত তৈরির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এগুলোর ঘাটতি হলে শরীর পর্যাপ্ত রক্ত তৈরি করতে পারে না।
- অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ: মহিলাদের মাসিকের সময় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হলে, গর্ভাবস্থায় রক্তের পরিমাণ বৃদ্ধি হলে।
- হিমোগ্লোবিন সংশ্লেষণের সমস্যা: সিকেল সেল এনিমিয়া, থ্যালাসেমিয়া ইত্যাদি জেনেটিক রোগের কারণে শরীর পর্যাপ্ত হিমোগ্লোবিন তৈরি করতে পারে না।
রক্তে হিমোগ্লোবিন কমে যাওয়ার চিকিৎসা ও প্রতিরোধ ব্যবস্থাঃ
হিমোগ্লোবিনের ঘাটতি পূরণে কয়েকটি প্রতিরোধ ব্যবস্থা ও চিকিৎসা নেওয়া যেতে পারে। যেমন-
- পুষ্টিকর খাবার: লৌহযুক্ত খাবার যেমন- লাল মাংস, ডিম, পালং শাক, কলা, গাজর খাওয়া উচিত। এছাড়া লিভার, মসুর ডাল, বিভিন্ন বীজযুক্ত খাবার গ্রহণ করতে হবে।
- ভিটামিন সি গ্রহণ: ভিটামিন সি আয়রন শোষণে সাহায্য করে। ফলে ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফল যেমন- কমলা, টমেটো, স্ট্রবেরি খাওয়া উচিত।
- আয়রন সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ: ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী আয়রন ট্যাবলেট বা ইনজেকশন গ্রহণ করা যায়।
- জেনেটিক রোগের ক্ষেত্রে বিশেষ চিকিৎসা: সিকেল সেল এনিমিয়া বা থ্যালাসেমিয়ার মতো রোগের ক্ষেত্রে বিশেষ চিকিৎসা এবং নিয়মিত রক্ত পরিসঞ্চালন প্রয়োজন।
রক্তে হিমোগ্লোবিনের ঘাটতি হলে তা শরীরের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গে প্রভাব ফেলে। দীর্ঘমেয়াদে এই ঘাটতি পূরণ না হলে হৃদরোগ, কিডনি সমস্যা ও শ্বাস-প্রশ্বাসের জটিলতা দেখা দিতে পারে। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ এবং প্রয়োজন অনুযায়ী চিকিৎসা নেওয়া উচিত। যাতে রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা স্বাভাবিক থাকে এবং শরীর সুস্থ থাকে।
আমাদের আজকের ব্লগটি যদি আপনার ভালো লেগে থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে এটি আপনার সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোতে শেয়ার করুন। আপনার বন্ধুদের ও জানার সুযোগ করে দিন। এছাড়াও আপনারা পরবর্তীতে কোন বিষয়ে ব্লগ পড়তে চান, তা কমেন্টের মাধ্যমে জানাতে পারেন। আপনাদের মতামত আমাদের পরবর্তী কনটেন্ট তৈরি করতে ও লিখতে অনুপ্রেরণা জোগাবে।